“হ্যাঁ, কথা তো ভালোই । যেদিন আমি এ কথা ঘোষণা করব, সেই দিনই আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার বিরুদ্ধে এই বলে তুফান সৃষ্টি করবে যে, সনাতন কার থেকে চলে আসা এক সেতুকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি।”
“বোধিসত্বা-জীবনের মহিমা সম্বন্ধে অহনিশি যে উপদেশ প্রচারিত হচ্ছে, করাও ওপর কোনো প্রভাবই কি তার পড়েনি? আমি বিশ্বাস করি মহারাজ, নিশ্চয় এর প্রভাব পড়েছে, এবং যদি বোধিসত্বের ন্যায় আপনি আপনার সমস্ত কিছু ত্যাগ করার জন্য প্রস্তত হন, তবে আপনাকে অনুসরণ করে চলার পথিকও পাওয়া যাবে।”
“রাজ্যের ভিতরকার প্রশ্নই শুধু নয়, পরমভট্টারকদেবও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠবেন।”
“শীলাদিত্য! যে ‘নাগানন্দ’ নাটকে বোধিসত্বের উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত করেছে?”
“হ্যাঁ, প্রচলিত লোকাচার উঠিয়ে দেওয়া তাঁরও ক্ষমাতাধীণ নয়।”
“এমন কথা যদি তথাগত, যদি আর্য অশ্বঘোষ অথবা নাগার্জুন মনে করতেন?”
“তাঁদের সাহস ছিল, তবু রীতি বর্জন করে তাঁরাও বেশী দুর যেতে পারেননি।”
“বেশীদুর নয়, অল্প দুরই আপনি চলুন মহারাজ, কিছুদুর আপনি অগ্রসর হন।”
“আপনি কি আমাকে নিজ মুখ দিয়ে কাপুরুষ বলিয়ে ছাড়বেন?”
“কাপুরুষ বলছি না। কিন্তু শুনুন, ধর্ম আমাদের কাছে এক নাগপাশ বিশেষ!”
“আমার অন্যরকে জিজ্ঞাসা করলে আমি ‘হ্যাঁ’ বলব, রসনাকে জিজ্ঞাসা করলে সে পরিষ্কার ‘না’ বলবে অথবা একেবারেই মৌনব্রত ধারণ করবে।”
* * *
ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আমার ঘৃণা ধরে গেছে! বস্তুত কামরূপ নৃপতির মতো বহু সদন্তঃকরণ লোককে কাপুরুষ রূপে সৃষ্টি করার অপরাধ এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের। যে দিন এই ধর্ম এ দেশ থেকে উঠে যাবে, সেদিন পৃথিবীর এক গুরুতর কলঙ্ক ঘুচে যাবে। নালন্দায় এসে বিদেশী ভিক্ষুদের কাছেআমি শুনেছি, তাদের দেশে ব্রাহ্মণের ন্যায় কোনো সর্বশক্তিমান ধর্মনায়কের জাতি নেই। তাদের কথায় বুঝেছি যে, কেন সেই সব দেশে দণ্ড এবঙ মুখপাত্র বহনকারী চণ্ডালের দেখা পাওয়া যায় না। ব্রাহ্মণেরা আমাদের দেশে মানুষকে ছোট বড় জাতে এমনভাবে ভাগ করে দিয়েছে যে, কেউই নিজের চেয়ে নীচু জাতের লোকের সঙ্গে মিশতে প্রস্তুত নয়। এদের ধর্ম আর জ্ঞান নিছক রাহুকেতুর ছায়া বিশেষ।
নালন্দায় দেশেদেশান্তরের বিচিত্র সংবাদ পাওয়া যেত এ জন্য আমি দু-এক বছরনানা দেশ পর্যটন করে পুনরায় ছয় মাসের জন্য নালন্দায় চলে যেতাম। একবার এক পারসিক ভিক্ষু বলেছিলেন যে, তাঁর দশে কিছুকাল পুর্বে মজদ্ক নামে এক বিদ্বান ছিলেন, যিনি এক প্রকারের সঙ্ঘবাদের (যতদূর পযন্ত সম্পত্তির প্রশ্ন রয়েছে) প্রচার করেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্ঘবাদ এখন শুধু বিনয়পিটকে পঠনীয় বস্তু মাত্র। আজ বড় বড় বৈয়ক্তিক (পৌদগলিক) সম্পত্তি ভোগকারী ভিক্ষু রয়েছে। আচার্য মজদক ব্রহ্মচর্য এবং ভিক্ষুবাদ মানতেন না। তিনি মানুষের স্বাভাবিক জীবন—প্রেমিক-প্রেমিকা, পুত্র-পৌত্রের জীবনকেই শুধু স্বীকার করতেন; কিন্তু বলতেন সকল পাপের মুল হল ‘আমি’ এবং ‘আমার’। তিনি বলেছিলেন, ‘সম্পত্তি স্বতন্ত্র হওয়া উচিত নয়, প্রেম স্বেচ্ছানুযায়ী চলবে এবং সন্তান সকলের সম্মিলিত সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। জীবে দয়া এবং সংযমের শিক্ষাও তিনি দিতেন। তাঁর মতবাদ আমার কাছে সুন্দর মনে হল। আমি যখন শুনলাম যে, মজদ্ক এবং তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুচরকে মেরে এক পারসিক রাজা—নোলেরিয়াঁ, ন্যায়মূর্তি উপাধি ধারণ করেছে, তখন বুঝতে পারলাম, যতদিন পর্যন্ত রাজা থাকবে যতদিন তাদের দান-পুণ্যের সাহায্যে বেঁচে থাকা শ্রমণ-ব্রাহ্মণ থাকবে, ততদিন পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হতে পারে না।
১৪. চক্রপাণি (কাল : ১২০০ খৃষ্টাব্দ)
এই সময় কনৌজ ভারতের সবচেয়ে বড় সমৃদ্ধ নগর ছিল- তার জমকালো হাট-বাট, চৌরাস্তায়। মিষ্টন্ন, সুগন্ধি তৈল, অলস্কার এবং অন্যান্য বিহুবিধ জিনিসের জন্য সারা ভারহে প্রসিদ্ধ ছিল কনৌজ। ছ’শ বছর ধরে মৌখরি, বৈশ্য, প্রতিহার, গহড়বার মতো ভারতের তদানীন্তন সর্বোচ্চ রাজবংশগুলোর রাজধানী থাকার ফলে তার প্রতি শ্রদ্ধার ভাবও লোকের মনে সজ্ঞাত হয়েছিল। সেই কারণে হিন্দুরা নিজেদের পদবীর সঙ্গে কনৌজ শ্বদটি জুড়ে নিত। তাই আজও ব্রাক্ষণ, আহীর, কাঁছ ইত্যাদি বহু জাতির মধ্যে কান্যকুজ ব্রাক্ষণ, কান্যকুজ আহীর ইত্যাদি দেখা যায়। পদবীর আগে কনৌজ শ্বদটি যোগ হলে হিন্দুদের মধ্যে কুলজ মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। হর্ষবর্ধনের সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত জগতে বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে, কিন্তু তখনকার চেয়ে এখন ভারতীয় মনোরাজ্যে অধিকতর কৃপমন্ডুকতা এসে বাসা বেঁধেছে।
হর্ষবর্ধরে সময়ে আরবে এক নতুন ধর্ম- ইসলাম জম্মলাভ করে। সেই সময় কে বলতে পেরেছিল,ইসলামের সংস্থাপকের মৃত্যুর (৬২২ খৃঃ ) একশ’ বছরের মধ্যেই এই ধর্ম সিন্ধু থেকে স্পেন পর্যন্ত ছেড়িয়ে পড়বে! এতদিন জাতি এবং রাজার নামে দেশবিজয়ের কথাই শোনা গিয়েছিল, এ-বার ধর্মের নামে দেশ জয়ে কথা প্রথম শোনা গেল। আপন শিকার-সমুহকে সতর্ক হবার সুযোগও সে দিল না এবং তাদের একের পর এক প্রাস করে ফেললে। সাসানিগণের ( ইরাণীগণের ) শক্তিশালী সাম্রাজ্য তআরবদের স্পর্শমাত্র কাগজের নৌকার ন্যায় গেল পড়ল, এবং ইসলাম সংস্থাপকের মৃত্যুর পর দুই শতাব্দী পার হতে না হতে ইসলামী রাজ্যের ধ্বজা পামীরের ওপর উড়তে লাগল।