জলন্ত শব্দাঙ্গার নিক্ষেপ করে ধর্মকীর্তি এই ঘোর তমসাকে দুর করবার প্রচণ্ড চেষ্টা করেন; কিন্তু তৎকালে এর থেকে কোনো সুফল ফলতে আমি দেখিনি। আমি একাই উজ্জল দীপযষ্টি বহন করে চলতে কৃতসঙ্কল্প হলাম। এর একটা ফল এই হলে যে, আমি দুর্মুখ বনে গেলাম। এখানে এ কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, আপন রসনার ব্যবহারে আমাকেও রাজসত্তার ওপর প্রত্যক্ষ আক্রমন না-তরা সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হত, না হলে দুর্মুখের মুখ দশ দিনেই বন্ধ করে দেওয়া হত! তা সত্বেও নিজিকে বাঁচিয়ে কখনও কখনও আমি বহু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতাম
মরণের পর মুক্তি এবং নির্বাণ-প্রাপ্তির যে-কথা তোমরা বল,কি অর্থ আছে তার?
যে লক্ষ লক্ষ দাসকে পশুরন্যায় আবদ্ধ রেখে ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে, তাদের কেন মুক্ত করার চেষ্টা কর না? প্রয়োগের মেলায় একবার রাজা শীলদিত্যকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, মহারাজ, আপনি যে বড় বড় বিত্তশালী মঠ এবং ব্রাহ্মণদের মাঝে প্রতি পঞ্চম বৎসরে এত ধন-দৌলত বিতরণ করছেন, সেগুলি যদি দাসদাসীদের মুক্ত করার কাজে লাগাতেন, হা’হলে কি তাতে কম পুণ্যের কাজ হত?”
একান্ত সময় আলোচনা করার কথা বলে শীলাদিত্য এ প্রশ্ন এড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই ‘অন্য সময়’ও আমি খুঁজে বর করলাম। রাজার ভগ্নী ভিক্ষুণী জোর করেই সে সুযোগ সৃষ্টি করে দিল। রাজ্যশ্রীর সামনে আমি দাসদাসীদের নরক-যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরলাম। তার হুদয় বিগলিত হয়ে গেল। তারপর যখন আমি বললাম যে, অর্থ দিয়ে এই সানতন বংশপরস্পরায় বন্দী মানুষের মুক্তি দান করা সবচেয়ে পুণ্যের কাজ, তখনই সে কথা তার মনে ধরে গেল। বেচারী সরল-হুদয়া স্ত্রীলোক, দাসস্থের আবরণে লুকায়িত বড় বড় স্বার্থের কথা সে কি জানে? সে কি করে জানবে যে, যেদিন মাটিকে স্বর্গে পরিণত করা যাবে, আকাশের স্বর্গ সেদিন হেলে পড়বে! আকাশ-পাতাল, স্বর্গ-নরগ কায়েম রাখার জন্য, তাদের নামে লাভের কারবার চালানোর জন্য –পৃথিবীতে স্বর্গ-নরক, রাজা-ভিখারী, দাস-স্বামীর প্রয়োজন হয়।
রাজা নির্জনে বসে আলোচনা করল। প্রথমে সে বলল, “একবার অর্থব্যয় করে তাদের আমি মুক্ত করতে পারি, ক্নিতু দারিদ্র্যের চাপে সে মুক্তি বিকিয়ে যাবে।”
“ভবিষ্যতের জন্য মানুষের ক্রয়-বিক্রয় দন্ডনীয় করে দিন।”
এরপর সে চুপ করে ভাবতে লাগল। আমি তার সামনে ‘রাগানন্দের’ নাগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরলাম, যে অপরের প্রাণরক্ষার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছিল। ‘নাগানন্দ’হর্ষরাজের সৃষ্ট নাটক বলে কথিত, সুতরাং কি জবাব দেবে সে? শেষকালে সে জানল যে, দাসদাসীদের মুক্ত করায় সে ততটা কীর্তিলাভের আশা রাখে না, যতটা রাখে শ্রমণ-ব্রাক্ষণদের ঝুলি ভরায় বা বড় বড় মঠ মন্দির নির্মাণে । এই দিন আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, সে শীলাদিত্য নয়- শীলান্ধকার।
বেচারা শীলাদিত্যকেই বা আমি কেন দোষ দিই? আজকাল কুলীন নাগরিক হওয়ার লক্ষণই হল যে, সকলেই পরস্পরকে বঞ্চনা করে চলেছে। পুরাতন বৌদ্ধগ্রন্থে বুদ্ধকালনি রীতিনীতির কথা পাঠ করে আমি জেনেছি, পূর্বে মদ্যপান জলপানেরই সামিল ছিল। মদ্যপান না করাকে সে সময় উপবাস-ব্রত বলে মনে করা হত। আজকাল ব্রাহ্মণেরা মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছে এবং প্রকাশ্য মদ্য পান করায় শাস্তি পেতে হয়। এ সবের পরিণাম কি? দেবতার নামে সিদ্ধি-সাধনার নামে লুকিয়ে ভৈরবীচক্র চলছে। ব্রহ্মচর্য নিয়ে মহা সোরগোল সুরু হয়েছে, কিন্তু পরিণাম? ভৈরবীচক্রে আপন-পর সকল স্ত্রী ভোগাধিকারভুক্ত। এর চেয়েও জঘণ্য ব্যাপার, দেবতার বরদানে নামে সেখানে মাতা-ভগ্নী-কন্যা পর্যন্ত ভোগাধিকারভুক্ত হয়ে উঠেছে। আর পরিব্রাজক,ভিক্ষু এদের আখড়াগুলি অপ্রাকৃতির ব্যভিচারে আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।
যদি সত্যই এই জগৎকে দেখাশোনার কেউ থাকত, তবে এই বঞ্চনা, এই অন্ধকার এক মুহূর্তের জন্যও সে বরদাস্ত করত না।
৪
একবার আমি কামরূপ গিয়েছিলাম। সেখানকার রাজা নালন্দার ভক্ত এবং মহাযানের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান। ইম বলেছিলাম, “মহাযাত্রী বোধিসত্বের ব্রতকে আপনি মান্য করেন, যে ব্রতে বলা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত একটিও প্রাণী বন্দী হয়ে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাণ আমার কাম্য নয। মহারাজ আপনার রাজ্যে অনেক চণ্ডাল আছে, যারা দণ্ড হাতে নিয়ে নগরে আসে আর রাস্তায় আওয়াজ করতে করতে যায়। তার লোককে সচেতন করে দেয়, যাতের তাদের ছোঁয়া লেগে কেউ যেন অস্পৃশ্য না হয়। তারা হাতে করে পাত্র বয়ে নিয়ে চলে, যাতে তাদের অপবিত্র থুতু নগরেরপবিত্র মাটিতে না পড়ে। কুকুরকে স্পর্শ করলে মানুষ অপবিত্র হয় না, তার বিষ্ঠাও নগরকে চিরদুষিত কর রাখে না। তবে কি চণ্ডালেরা কুকুরের চেয়েও অধম?”
“কুকুরের চেয়ে অধম নয়। এদের মধ্যেও জীবন-প্রবাহ নিহিত আছে, যা বিকাশিত হয়ে বৌদ্ধিক উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারে।”
“তা’হলে রাজ্যে ঢোল বাজিয়ে ঘোষণা করে দিন না যে, আজ থেকে কোনো চণ্ডালকে নগরে আসতে দণ্ড অথবা কিদানী বয়ে আনতে হবে না?”
“এ আমার শক্তির অতীত; সমাজ-ব্যবস্থা এমনভাবেই রচিত হয়েছে।”
“বোধিসত্বের ধর্মে—মহামানবের কি এই ব্যবস্থা?”
“কিন্তু এখানকার সকল প্রজা তো মহামন্ত্র অনুসরণ করে চলে না।”
“গ্রামে, শহরে সর্বত্র আমি ত্রিরত্বের জয়দুন্দুভি বেজে উঠতে দেখেছি।”