হষেৃর সম্বন্ধে যদি আমার গোপন মতামত জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমি বলব যে, তার সমেয় সে মন্দ লোক বা মন্দ রাজা ছিল না। আপন ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে তার অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল। ভাইয়ের জন্য যদি ‘সতী’ হওয়ার বিধান ধর্মনায়কগণ দিত অথবা তার সামান্য ইঙ্গিত করত, তবে সেও তাই করে বসত। কিন্তু তার মধ্যে অনেক দোষও ছিল, এবং সব চেয়ে বড় দোষ ছিল মিথ্যা ঠাট দেখানোÍপ্রশংসার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সে-সম্বন্ধে নিস্পৃহ দেখাত; সুন্দরীদের সম্বন্ধে কামনা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে কামনা রহিত বলে জাহির করত। যশোস্পৃহা সত্ত্বেও যশ থেকে দুরে থাকার প্রয়াস পেত। হর্ষকে না জানিয়ে আপন নাটকসমূহকে ‘নিপুণ কবি হর্ষ’ এই নামে আমি নিজের লেখা নাটককে রাতদিনের সঙ্গ লাভের পরও সে কখনও আমাকে বলেনি, ‘বাণ, এখন এই নাটকগুলিকে তোমার নামেই প্রচারিত হতে দাও।’ এ কাজ তার পক্ষে একেবারেই সহজ ছিল। তার অধীন সামন্ত-দরবারে শুধু একবার ‘শ্রীহর্ষো নিপুণঃ কবি’ এই জায়গায় ‘শ্রীবাণো নিপুণঃ কবিঃ’ এই নামে নাটকের অভিনয় করালেই হত।
জগৎ যেমন রয়েছে তাকে ঠিক তেমনিভাবে চিত্রিত করায় আমার আগ্রহ। আমি বারোটি বছর যদি পর্যটনে না কাটাতাম, তবে সম্ভবত এই আগ্রহ জন্মাত না, জন্মালেও আমি সেটা চরিতার্থ করতে পারতাম না। আমি যেখানে অচ্ছোদ সরোবরের বর্ণনা দিয়েছি, সেখানে হিমালয়ের পর্বতের এক সুন্দর দৃশ্য আমার মানসপটে ছিল। কাদমরী-ভবনের বর্ণনায় হিমালয়ের দৃশ্য ছিল। বিদ্ব্যাটবতী নিজেরই দেখা এক বৃদ্ধ দ্রাবিড় ধার্মিককে আমি বসিয়েছি। কিন্তু শুধু এইটুকু চিত্রণে আমি আামার লেখনীকে বিশ্রাম দিতে চাইনি। রাজন্যবর্গের প্রাসাদ, অন্তুঃপুর এবং তাদের ধন-দৌলতের চিত্রণ আমি আামার গ্রন্থে করেছি; কিন্তু আমি পর্নকুটির এবং তার দুঃখদুর্দশাপূর্ণ জীবনকে চিত্রিত করতে পারিনি, যদি করতাম তবে ঐ সব রাজপ্রাসাদ এবং রাজসম্পদভোগীদের ওপর এমন গভীর কালিমা লেপন করতে হত যে, প্রতি পঞ্চম বছরে প্রয়াগে রাজকোষÍভুল বলা হল, উদ্ধৃত্তকোষ উজাড়-করা হর্ষ আমাকে শুধু লম্পট উপাধি দিয়েই সন্তুষ্ট থাকত না।
৩
আমাকে লোকে দুর্মখ বলে, কেন না কটুসত্য বলা আমার অভ্যাস। আমাদের সময়ে আরও কটুসত্য বলার লোক যখন-তখন দেখা যেত; কিন্তু তারা সে সব কথা বলত পাগলামীর ছলে, যার ফলে অনেকেই তাদের সত্যিকারের পাগল মনে করত এবং অনেকে মনে করত শ্রীপর্বত থেকে আগত কোনো অদ্ভুত সিগ্ধপুরুষ বলে। আমিও এই শ্রীপর্বতের যুগে এক খাসা সিগ্ধপুরুষ সাজতে পারতাম; আর তা’হলে আমার নাম দুর্মুখ হত না। কিন্তু এই লোকবঞ্চনা আমার কাম্য নয়। লোকবঞ্চনার কথা মনে করেই আমি নালন্দা ছেড়েছি, না হলে আমিও সেখানকার পণ্ডিত, মহাপণ্ডিত হয়ে যেতাম। সেখানে এক ব্যক্তিকে আমি অন্ধকার রাত্রিতে জলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করতে দেখেছিলাম; কিনউত এত্ত দেখিছিলাম; কি রকমভাবে তাঁর শত্রুমিত্র সকলেই তাঁর পিছনে লেগেছে। সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনাদের হয়ত কৌতুহল জেগে থাকবে। তিনি তার্কিক শ্রেষ্ঠ, নালন্দায় বসে ভঙ্কানিনাদে তিনি বলেছিলেন, বুদ্ধির ওপর পুথিকে স্থান দেওয়া, ঈশ্বরকে সংসারের কর্তা মনে করা, ধর্মপালনের ইচ্ছা, জন্ম-জাতির অভিমান, পাপক্ষয় করার জন্য শীররকে সস্তপ্ত করাÍবিবেচনাহীন জড়ত্বের পঞ্চলক্ষণ এগুলি।
ধর্মকীর্তিকে আমি বলেছিলাম, æআচার্য’ আপনার অস্ত্র তীক্ষ্ণ, কিন্তু এত বেশী সুক্ষ্ণ হয়ে গেছে যে, লোকের নজরেই পড়বে না।”
বেদপ্রমাণ্যং কণ্যচিৎকর্তৃবাদঃ স্নানে ধর্মেচ্ছা জাতিবাদাবলেপ:।
সন্তাপারম্ভঃ পাপহানায় চেতি ধ্বস্তপ্রজ্ঞানাং পঞ্চালিদানি জাভ্য়েঃÍপ্রমাণবার্তিক ধর্মকীর্তি বললেন, æআমার অস্ত্রের দুর্বলতার কথা আমি নিজেও বুঝি। আমি যাকে ধ্বংস করতে চাই তার জন্য আমাকে সব কিছু ত্যাগ করে চোখ-ঝলসানো প্রচণ্ড অস্ত্র ধারণ করতে হবে। নালন্দার মহাস্থবির (সন্ত-মহন্ত) ইতিমধ্যেই আমার ওপর অসন্তুষ্ট। তুমি কি মনে কর একটি বিদ্যার্থী লাভেও আমি সমর্থ হতে পারব, যদি আমি বলতে আরম্ভ করি নালন্দা এক প্রহসন বিশেষ! এখানে এমন সব বিদ্যার্থী আসে, যারা বিশাল জগৎকে আলোকিত করতে পারে না, যারা আপন জ্ঞানলোকে অজ্ঞ-স্বল্পজ্ঞদের চোখেই শুধু ধাঁধার সৃষ্টি করতে পারে! শীলাদিত্য প্রদত্ত গ্রাম থেকে যারা সুগন্ধি চাল, মশলা, ঘি, খেজুর ইত্যাদি পায় তারা তার ভোগ-শিকাররূপী প্রজা-সাধারণকে বিদ্রোহী হওয়ার শিক্ষা কেমন করে দেবে?”
আচার্য, এই অন্ধকার থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোন পথ কি পেয়েছেন?”
পথ? সকল রোগেরই মহৌষধ আছে, সকল রকম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা অথবা কোনো না কোনো পথ আছে কিন্তু এই অন্ধকার রাত্রি থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা অথবা বৈতরণীর সেতু একদিনে তৈরী হতে পারে না বন্ধু! কারণ এর নির্মাণকারীর সংখ্যাঅ কম এবং অপরদিকে অন্ধকারের দুর্ভেদ্যতা অত্যন্ত প্রবল।”
তা’হলে কি হতাশ হয়ে বসে পড়তে হবে?”
বসে পড়াটা লোকবঞ্চনা থেকে ভালো। দেখছ না, যাদের পথ-পদর্শক হওয়া উচিত তারাই কি রকম প্রবঞ্চক? আর এই অবস্থা শুধু মাত্র এই দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই। সিংহল, সুবর্ণদ্বীপ, যবদ্বীপ, কম্বোদ্বীপ, চীন, তুষার, (মধ্য এশিয়া) পারস্য কোন জায়গায় বিদ্বান ও বিদ্যার্থী নালন্দায় নেই? এদের সঙ্গে আলোচনা করেলেই বোঝা যায় যে দুনিয়া অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে গেছেÍধিগ্ ব্যাপকং তমঃ!”