রাজ্য গ্রহণ করতে ও আমি অস্বীকার করেছিলাম, কারণ স্থাম্বীশ্বরপতি মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের পুত্র, কান্যকুজাধিপতি পরমভট্রারক মহারাজাধিরাক রাজ্যবর্ধনের অমুজ হয়ে, আমি শুধু রাজ্যভোগ দেখে নয়, নিজে ভোগ করে তার অসারতা উপলব্ধি করেছি। যদি ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধের ক্ষত্রিয়োচিত শুভবুদ্ধি মনে জাগ্রত না হত তবে সম্ববত কান্যকুজ্ঞের সিংাসনে আমি বসতাম না। এর ফলে আমার বোন রাজ্যশ্রীর প্রতিপক্ষ মৌখরি বংশ এই রাজ্যের শাসক হত। আর বস্তুত আমার ভ্রাতার পুর্বে, গুপ্তরা চলে যাবার পর তারাই রাজ্যশাসন করত। এ সব আমি এই জস্যই বলছি যে, আমার পরবতীরা যাতে বুঝতে পারে যে হষূ স্বার্থাদ্ব হয়ে নিজ মস্তকে রাজমুকুট ধারণ করেনি। আমার দুঃখ হয় আমার দরবারী মোসাহেবরা (রাজা মোসাহেবদের সঙ্গ ছাড়তে পারে না, এই বড় মুস্কিল) আমাকে ও সমুদ্যগুপ্ত এবং চন্দ্রগুপ্তবিক্রমাদিত্যের রঙে রাঙিয়ে তুলতে চায়; কিন্তু এতে তারা আমার প্রতি খুবই অন্যায় অবিচার করেছে।
আমি রাজ্য গ্রহণ করেছি শুধু শীলতা এবং ধর্মপালনের জন্যে। বিদ্যা দানকে আমি শ্রেষ্ঠদান বলে মনে করেছি, এ জন্যে গুপ্তদের সময় থেকে চলে আসা ক্রমবর্দ্ধমান নালন্দার সমৃদ্ধিকে আমি আরও বাড়িয়ে তুলেছি, যাতে দশ জমস্র দেশী-বিদেশী পন্ডিত এবং বিদ্যার্থী সর্ববিধ সুযোগ সহ সেখানে বিদ্যাধায়ন করার সুবিধা লাভ করে। বিদ্বানের সম্মান লাভ করা আমার কাছে সব চেয়ে সন্তোষদায়ক, এ জন্য আমি চীনের বিদ্বান ভিক্ষু হয়েন সাঙকে সমস্ত অন্তর দিয়ে সম্মানিত করেছি। বার্ণের অপূর্ব কাব্যপ্রতিভা দেখে আমি তাকে লাম্পট্যের পথ থেকে সরিয়ে েএনে সুপথে চালনা করতে চেয়েছি, যদিম সে বেশী ওপরে উঠতে পারেনি শুধু চাটুকার কবি হিসাবেই রয়ে গেছে। কিন্তু মগধের এক ছোট অখ্যাত গ্রাম থেকে নিয়ে এসে তাকে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করার প্রয়াস আমার বিদ্যানুরাগেরই পরিচায়ক”।
আমি চেয়েছিলাম সকলেই আপন-আপন ধর্ম পালন করুক। স্ব-ধর্মের পথেই চলা উচিত কারণ এতে সংসারে শান্তি এবং সমৃদ্ধি বিরাজ করে এবং স্বর্গের সৃষ্টি হয়। সকল বর্ণের লোক নিজ নিজ বর্ণধর্ম পালন করুক, সকল আশ্রমের লোক আপন আশ্রম পালন করুক, সকল ধর্মমত আপন শ্রদ্ধা-বিশ্বাস অনুযায়ী পূজা-পাঠ করুক-এজ ন্য আমি সদা পযত্নশীল ছিলাম।
কামরূপ থেকে সৌরাষ্ট্র এবং বিন্ধা থেকে হিমালয় পযর্ন্ত বিস্তৃত নিজ রাজ্যে আমি ন্যায়রাজা স্থাপন করেছি। আমার অধিকারীরা (অফিসার) যাতে প্রজাবৃন্দের ওপর জুলুম করতে না পারে, এ জন্য আমি স্বয়ং চক্রভ্রমণে বের হতাম।
এমনই এক পর্যটনে ব্রাহ্মণ বাণ আমার আহবানে আমার কাছে এসেছিল। আমি জানি, সে আমার কীর্তির মহিমা কীর্তন করতেই চেয়েছিল। কিন্তু আমার পর্যটনের সময়েও আমার রাজৈশ্বর্ষ আড়ম্বের যে বর্ণনা সে লিপিবদ্ধ করেছে তা আমার নয়, কোনো বিক্রমাদিত্যের দরবারের হতে পারে। গোপনে গোপনে সে আমার জীবনী ( হর্শ্বচরিত) লিখছিল। ব্যাপারটা আমি আকদিন জানতে পেরে তাকে প্রশ্ন করলাম । লিখিত অংশ সে আমাকে দেখিয়েছিল, দেখে আমি খুব অসু্ন্তুষ্ট হলাম এবং তিরস্কার ও করলাম। যার পরিণামে সে আর তত উৎসাহের সঙ্গে লিখে যেতে পারল না। তার লেখা ‘কাদম্বরী’ আমার অপেক্ষাকৃত পছন্দ হয়েছিল। যদিও তাতে রাজদরবার, অন্তঃপুর, পরিচারক পরিচারিকা, প্রাসাদ, ভোগবিলাস ইত্যাদির এমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছির যাতে লোকের অযথা ভ্রম হয় যে, এই সমগ্র বর্ণনা আমারই রাজদরবারের। আমার রাণীদের মধ্যে পারস্য কন্যার সঙ্গেই আমার গভীর প্রণয় ছিল। সে নৌশেরওয়াঁর নাতনিই শুধু নয়, উপরস্তু আপন রুপও গুণের দ্বরা যে কোনো পুরুষকে সে মোহাচ্ছন্ন করতে পারত! বাণ তাকেই মহাশ্বেতা বলে বর্ণনা করেছিল। আমার সৌরাষ্টী রাণীর যৌবন পেরিয়ে এসেছিল, তাকে খুশী রাখবার জন্য আামি তার আবাসস্থল সজ্জিত করতে কিছুটা বিশেষ আয়োজন করেছিরাম। একই বাণ ‘কাদম্বরী’ এবং তার নিবাস রুপে অস্কিত করল। বাণের রচনার এই দুট বিষয় ছাড়া বাকি সমস্ত বিষয় মোটেই আমার সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়, অথবা অম্যন্ত অতিশয়োত্তিপূর্ণ।
আমার অন্তিম সময়ে অনুভব করছি, বাণ আমার হিতৈষী বলে প্রমাণিত হবে না। বাণের ‘হর্ষচরিত’ শুধু নয়, ‘কাদম্বরী’তেও রাজ্য আর তার ঐশ্বর্ষ সম্বন্ধে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে, লোকে সে সব আমার বিষয়ে বর্ণনা বলেই ধরবে। ‘নাগানন্দ’ ‘রত্বাবলী’ এবং প্রিয়দর্শিকা’ রাটককে আমার নামে লিখে সে তো আরও অনর্থ করেছে। লোকে বলবে, কীর্তির জন্য লালায়িত হয়ে আমি অপরের রচনা টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। বিশ্বাস করুন, বহুকাল পরে এই বিষয়টা আমি জানতে পেরেছি যখন হাজার হাজার বিদ্যার্থী আমার নামে এই প্রন্থাবলী পড়ে ফেলেছে এবং অনেকবার এগুলো অভিনতিও হয়ে গেছে। আমি আপন প্রজাদের সুখী দেখতে চেয়েছিলাম , তা আমি দেখেছি। নিজের রাজ্য শান্ত এবং নিরাপদ দেখতে চেয়েছিলাম, সে সাধও পূর্ণ হয়েছে। আমার প্রজারা সোনা বোঝাই করে নিশ্চিন্তে এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় যেতে পারছে।
আমার কুল সম্বন্ধে এখনই লোকে বলতে সুরু করেছে যে, এটা না-কি বেণেদের কুল। সম্পুর্ণ ভূল কথা। আমি শ্যৈ-ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য-বেণে নই। এক সময় আমাদের শাতবাহন কুলের হাতে সমগ্র ভারতের শাসনবার ছিল। শাতবাহন রাজ্যের ধ্বংসের পর আমাদের প্রজাগণ গোদাবরী তীরস্থিত প্রতিষ্ঠানপুর ( পেঠন )ছেড়ে স্থানবীশ্বর ( থানেশ্বর )চলে আসে। শাতবাহন ( শালিবাহন )বংশ ককনও বেণে ছিল না, সমস্ত জগৎ এ কথা জানে, শক ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে তাদের বিবাহাদি হত। রাজাদের যা কুল-লক্ষণ তার বিরোধী কিছু ছিল না। আমার প্রিয়া মহাশ্বেতাও পারসীক রাজবংশোদ্ভুতা।