‘বারবার তোমার সাহসের কথাটাই ভাবছি।’
‘মানুষ হয়ে জন্মানোর মূল্য শোধ দেবার জন্য সদা-প্রস্তুত থাকতে হয় সমদ, তাছাড়া, যে আদর্শে আমি বিশ্বাসী তাতে আমার দায়িত্ব অনেক বেশি।’
‘তোমার ধারণা এই যুদ্ধের পরিণতিতে বিশ্বে বিরাট পরিবর্তন সূচনা করবো?’
আগের মহাযুদ্ধ পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার সাম্যবাদী শক্তির উত্থান, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ মেহনতী মানুষের রাজ্য কায়েম করা বড় কম কথা নয়। তাই বর্তমান মহাযুদ্ধের শেষে-আমার বিশ্বাস, এই আকাশের নিচে এক নতুন পৃথিবী জেগে উঠবে। আমাদের সঙ্গে রয়েছে মহান সোভিয়েত, রয়েছে তার লালফৌজ, চীন, ইংলণ্ড আমেরিকার জনগণ সর্বস্ব পণ করে এই যুদ্ধে লড়ছে, তাই জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’
সমদ ও রূপাকিশোরদের তল্লাটে পাকিস্তানের দাবী নিয়ে আলোড়ন উঠেছে। রূপকিশোর সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলল, ‘গান্ধীবাদী স্বরাজ আসুক অথবা সাম্যবাদী স্বরাজ প্রতিষ্ঠা হোক, সেটা হবে গোটা ভারতবর্ষের জন্যে। মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে অখণ্ড ভারতে—আর এতে কি কোনো দ্বিমত থাকতে পারে সুমেরবাবু?
‘রূপকিশোর, ভারতবর্ষ শব্দটি একটি জটিল ধারণা মাত্র। স্বাধীনতা আমরা চাই কিন্তু এই দেশের জনগণই ঠিক করবে তাদের স্বাধীনতার স্বরূপ। স্বাধীনতা আকাশ থেকে টুপ। করে এ দেশের পুঁজিপতিদের মুঠোর মধ্যে পড়লে সেটা তো আর দেশের জনসাধারণের স্বাধীনতা হবে না!’
রূপ, ‘তোমার আদর্শ মতো স্বাধীনতা না-হয় এল, কিন্তু সেই স্বাধীনতার জন্য অখণ্ড ভারতকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা চলতে পারে না।’
সুমের, ‘রূপকিশোর, তুমি শব্দের গোলকধাঁধায় পড়ে গেছ। ভারত খণ্ডিত হওয়া বা অখণ্ডিত থাকা নির্ভর করছে সম্পূর্ণভাবে ভারতবাসীদের ওপর। একদা হিন্দুকুশ পার হয়ে আমুদরিয়া পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্রের সীমা ছিল এবং ভাষা, রীতি-রেওয়াজ ও ইতিহাসের দিক থেকে আফগান জাতি ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দশম শতাব্দী পর্যন্ত কাবুল হিন্দুরাজ্য ছিল—অখণ্ড হিন্দুস্থানওয়ালারা হিন্দুকুশ পর্যন্ত থাবা বাড়াতে রাজি আছে?
সিন্দু নদীর পশ্চিমে বসবাদকারী আফগানদের যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে অখণ্ড ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা না যায় তাহলে সিন্ধু, পশ্চিম পাঞ্জাব, কাশ্মীর, ও পূর্ববাংলার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেন তাদের অখণ্ড ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে?’
রূপ, ‘তাহলে ওদের ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে দিতে হবে!’
সুমের, ‘নিশ্চয়ই। আমরা জনগণের জন্যে লড়াই করছি, এর অর্থ হল যে, সমগ্র দেশের জনগণের কোনো একটি অংশকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরাধীনতায় রাখা চলবে না। পাকিস্তানের দাবীর মীমাংসা করা হিন্দু নেতাদের কাজ নয়, ঐ প্রশ্নের সমাধানের দায়িত্ব মুসলমান–প্রধান প্রদেশগুলি জনসাধারণের। যদি আমরা জনগণের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি। তবে পুঁজিপতি-রাজ কায়েম হবে এবং স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রও গড়ে উঠবে। যদি কায়িক ও মানসিক শ্রমজীবী মানুষের রাজত্ব কায়েম করতে পারি। তবে এই ভারতবর্ষের বহু স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর এক অখণ্ড রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। কিন্তু তার আগেই ভাষাগতভাবে পৃথক আশীটির বেশি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব যে এই বিশাল দেশে রয়েছে সেটা স্বীকার করে নিতে হবে।
‘আশীর বেশী? তুমি যে পাকিস্তানের দাবীকেও হার মানালে!’
‘যা বাস্তব তাকে অস্বীকার করি কি করে? আর মাতৃভাষা তাকেই বলে, যে ভাষায় কথা বলতে একটি বালকও ব্যাকরণে ভুল করে না। সোভিয়েত দেশ হল সত্তরটি জাতির সম্মেলনে এক বহুজাতিক রাষ্ট্র। সোভিয়েত দেশের দ্বিগুণ জনসংখ্যা অধুষিত ভারতবর্ষে যদি আশীটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা থাকে।তবে অবাক হওয়ার কি আছে?’
‘তবে কি তুমি পাকিস্তানের দাবীর পক্ষে?’
‘যতদিন এ দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মুসলমান ঐ দাবী করবেন, ততদিন পর্যন্ত। এটা তো দেখাই যাচ্ছে সমস্ত মুসলিম নেতারা ঐ দাবীতে অনড়। অমুসলমানদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের দাবীর বিরোধিতা করা ন্যায়সঙ্গত নয়। যদি মুসলমান-প্রধান প্রদেশের অধিকাংশ মানুষ অখণ্ড ভারতরাষ্ট্র থেকে পৃথক হয়ে যেতে চান তবে তাঁদের সে অধিকার মেনে নেওয়া উচিত।’
৩.
নিচে কালো সমুদ্রের জলরাশি যেন প্রাণহীন, সামনে সাদা মেঘের বিশাল পাহাড়। চলন্ত বিমানে বসে এমনিতে গতিবেগ অনুভব করা যায় না। অবশ্য সুমের তার সামনের গতি-পরিমাপক যন্ত্রে দেখল, সে ৩০০ মাইল বেগে উড়ে চলেছে। সুমের ভাবছিল, সুদূর অতীতে মানুষ যখন পাথরের অমসৃণ হাতিয়ার আবিষ্কার করেছিল সেই সময়ের কথা। নিশ্চয়ই সেদিনের মানুষ ঐ পাথরের অস্ত্ৰ হাতে নিয়েই নিজেকে প্রচণ্ড শক্তিধর মনে করেছিল। আর আজ মানুষ আকাশের অধীশ্বর। মানুষের অগ্রযাত্রার গতিবেগও কি প্রবল। সহসা তার মনে পড়ে-মানবতার ঘৃণ্যতম শত্রু ফ্যাসিষ্টদের কথা। যাদের চেষ্টা, মানব প্রগতির অবদানগুলির সাহায্য নিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা। ঘৃণায় সুমেরের দেহমন রি-রি করে ওঠে, তার খেয়াল হল প্রতিবেশী ব্ৰহ্মদেশ জাপানী ফ্যাসিষ্টদের কবলে। ভাবনার গতিমুখ ঘুরে চলে স্বদেশের মাটিতে… কদমকুঁয়ার ঘর-বাড়ি, মানুষজন, সেখানে একটি মেয়ে যে তার প্রিয়া। তার বৃদ্ধা মা, যে অচ্ছুৎসমাজের মধ্যে আজন্ম বন্দী হয়ে থেকে তার মতো একটি ছেলেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে।