‘আমি তো কোনো তফাৎ দেখছি না যুদ্ধের প্রথম অবস্থার সঙ্গে বর্তমানের।’
‘তফাৎ তো দেখতেই পাবে না-বেনিয়াগোষ্ঠীর লোক যে তোমরা। ফ্যাসিষ্ট শাসনেও বেনিয়াগোষ্ঠীর লোকের ঘি-মশলায় হাত পড়ে না। সোভিয়েত পরাজিত হলে মজুর কিষাণের সমস্ত আশা-ভরসা ধ্বংস হয়ে যাবে। ফ্যাসিষ্ট রাজত্বে মজুর-কৃষকরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবী তুলবারই সুযোগ পায় না; তাদের অবস্থা ক্রীতদাসদের মতো হয়ে ওঠে। আমাদের কাছে সোভিয়েত রাশিয়া অনেকগুলি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্র নয়–একমাত্র রাষ্ট্র। সারা বিশ্বের মেহনতী জনসাধারণের বন্ধন-মুক্তির একমাত্র আমার প্রদীপ। ঐ প্রদীপের শিখা নিভে গেলে সারা দুনিয়ায় ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে। তাই আমাদের দেহে যতক্ষণ প্ৰাণ আছে ততক্ষণ ঐ ফ্যাসিষ্ট স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব।’
‘কিন্তু সুমের, দেশে আরও অনেক সমাজবাদী রয়েছে, তারাও তো চায় জগৎকে শোষণমুক্ত করতে।’
‘সেবাগ্রাম থেকে প্ৰলম্বিত অন্ধকারে যে-সব সমাজবাদীদের অস্তিত্ব তাদের অভিভাবক শয়তান। হিটলারও নিজেকে সমাজবাদী বলে, গান্ধীর চেলারাও। কিন্তু সমাজবাদী বলে নিজেকে জাহির করলেই কি সমাজবাদী হওয়া যায়!–ভারতবর্ষ হিটলার-তোজের শাসনাধীনে এলে এ দেশ থেকে পুঁজিপতিরা খতম হবে না। বরং আরও বেশি শক্তিশালী হবে। ফ্যাসিষ্ট শাসনে সাম্যবাদীদের কি হাল হয় সেটা ইতালী ও জার্মানীর সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে। শুধু তাই বা কেন, ফ্রান্সে প্রতিদিন বহু কমিউনিস্টকে গুলি করে মারা হচ্ছে। যে নিজেকে মার্কসৃবাদী মনে করে ও এই যুদ্ধ থেকে। নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায় সে একই সঙ্গে নিজেকে এবং অপরকে প্রতারিত করে।’
‘তার মানে তুমি বলতে চাও, এ যুদ্ধে কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না?’
‘ঠিক তাই। যার মস্তিষ্ক যথাযথভাবে কাজ করছে তাকে একটা না একটা পক্ষ। অবলম্বন করতেই হবে। এই যুদ্ধের পরিণতিতে হয়। সাম্যবাদী শক্তি খতম হয়ে যাবে না। হলে এমন শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে, হিটলার-মুসোলিনী-তোজো এমন কি তাদের পিতৃপুরুষগণ-বন্ডউইন, চেম্বারলেন, হ্যালিফ্যাক্সদের পর রাখার মতো জমি দুনিয়ায় থাকবে না। যাদের তোমরা নিরপেক্ষ ভাবিছ তাদের নিরপেক্ষতা একটা লোক-দেখানো ব্যাপার।
‘আমাদের এখানকার ইংরেজদের মনোভাব তুমি কি লক্ষ্য করছ?’
‘ওরা অন্ধ-ত্রিশ বছর আগেকার জমানার গাড্ডায় পড়ে আছে এবং থাকতে চাইছে ওদের ধারণা যুদ্ধের শেষে দুনিয়ার হাল থাকবে যথা পূর্বম। এটাই স্বাভাবিক, যারা আমাদের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তারা পুরনোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবেই। দেখতেই পাচ্ছ, এ দেশের শাসক ইংরেজরা এখন সভামঞ্চ থেকে. ‘ জনগণকে আত্মত্যাগের উপদেশামৃত বিতরণ করছেন। অথচ গভর্নর, গভর্নর জেনারেলদের খরচের বহর দেখলে মাথা ঘুরে যায়। এ দেশের একজন মজুরের আয়ের সঙ্গে ঐ সব রাজপুরুষদের গত ২৫ বছরের আয়ের একটা তুলনা করলেই অসাম্যের আশমান-জমিন ফারাকটা খুব সহজেই বোঝা যায়। যেমন–
ভাইসরায়ের আয় ২,৫০,৮০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ১০,০০০ গুণ।
বাংলার গভর্নরের আয় ১,২০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,৮০০ গুণ।
যুক্ত প্রদেশের গভর্ণরের আয় ১,২০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,৮০০ গুণ।
বিহারের গভর্নরের আয় ১,০০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,০০০ গুণ।
এর সঙ্গে রাহা-খরচ, ছুটির বেতন এ সব ধরলে দেখা যাবে বাংলার গভর্নরের আয় একজন দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪২,২৩১ গুণ বেশি। এর পাশপাশি ইংল্যাণ্ডের অবস্থাটা দেখ, সেখানে কয়লাখনির একজন মজুরের সাপ্তাহিক বেতন আমাদের হিসাবে ৩৫ টাকার মতো। ক্ষেত মজুরের সাপ্তাহিক আয় ৪৫ টাকার কাছাকাছি। এর সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর বেতনের যদি তুলনা করা যায় তাহলে তিনি স্বদেশের মজুরশ্রেণীর তুলনায় ৩৬ গুণ বেশি পান। আর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বেতন সে দেশের সর্বনিম্ন মজুরীর মাত্র ৬ গুণ বেশি। আমাদের শেঠগোষ্ঠীর আয়ের অঙ্ক হিসাব করলে তো মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়।
‘এ দেখছি লুটতরাজের চাইতেও বেশি।’
‘অপরিণামদর্শী ইংরেজদের কাছ থেকে আমরা সামান্য কিছুও আশা করি না কিম্বা; তাদের বাঁচাবার জন্যে আমরা এ যুদ্ধে সামিল হইনি। আমাদের লড়াই আগামী দিনের পৃথিবীতে সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য-যেখানে শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থায় মানবতা সুউচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে।’
সমদ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এ বার জিজ্ঞেস করল, ‘সুমের, তোমার অনেক কথার সঙ্গে আমি এক মত আবার কিছু ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করি। কিন্তু তোমার আদর্শকে আমি কি পরিমাণে শ্রদ্ধা করি সেটা তো তুমি জানো। এটা আমিও স্বীকার করি যে, এই বিশ্বযুদ্ধে আমরা কেউই নিরপেক্ষ থাকতে পারি না। কিন্তু তুমি বিমানবাহিনীতে ভর্তি হবার পর খবরটা আমাদের দিলে কেন?’
‘হ্যাঁ আগে খবর দিই, আর বাছাই-পর্বে ছাঁটাই হয়ে যাই! ভর্তি হয়ে ২৪ ঘণ্টা আকাশে। উড়ে তবেই তোমাদের জানিয়েছি। এখন জানাজানি হলে কোনো ক্ষতি নেই কারণ পরশু। আম্বালায় বিমান-চালনা প্ৰশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে যাচ্ছি।’
‘তোমার মাকে খবর দিয়েছ?’
মা’র কাছে পাটনাও যা, আম্বালাও তাই। যতক্ষণ পরিষ্কারভাবে তাকে জানাতে না পারছি-আমি যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে মৃত্যুর মুখে চলেছি ততক্ষণ তাঁর কাছে সবই এক। মাকে এখনই সব কথা খোলাখুলি লেখার অর্থ তাঁর সর্বক্ষণের ঘুম কেড়ে নেওয়া। আমি ঠিক করেছি, যতদিন বেঁচে থাকিব ততদিন তাঁকে নিয়মিত চিঠি দিয়ে যাব, আর এতেই তিনি শান্তি পাবেন।’