‘আপনি কি চান না বর্ণহিন্দু এবং অচ্ছুতেরা এক হয়ে যাক?’
‘যুগের দাবীতেই আমরা হয়ত এক হব, কিন্তু গান্ধীজির প্রিয়-ধর্ম, ঈশ্বর, সনাতন পন্থা আমাদের ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধক। ওঝাজী, আমাকে দেখুন-আমার গায়ের রঙ পাকা গমের মতো, পাতলা উন্নত নাক। আর আপনার রঙ কালো, নাক চ্যাপ্টা। এর তাৎপৰ্য, আমার শরীরে আপনার তুলনায় আর্য রক্তের পরিমাণ বেশি। আপনার পূর্ব পুরুষরা বর্ণবিভাগের লৌহপ্রাচীর তুলে ভেবেছিলেন যে, রক্তের সংমিশ্রণ ঘটতে দেবেন না, কিন্তু তাঁদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আপনি এবং আমি–ভোলগা আর গঙ্গা তটের রক্তধারা সময়ের প্রবহমান গতিতে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই গায়ের রঙ নিয়ে ঝগড়া আর নেই। সব কিছুই ঠিক হয়ে যেত যদি ধর্ম, ঈশ্বর এবং সনাতনপন্থীরা এ–পথে বাধা হয়ে না থাকত। আর এখন শোষকশ্রেণী এবং তাদের প্রতিনিধি গান্ধীজি এসে আমাদের মিলনের পথকে আরও দুৰ্গম করে তুলেছেন।’
‘আচ্ছা, আপনি যখন চরকা-খাদি এ সবের ওপর আস্থা রাখেন না তখন কি মনে করছেন, বিদেশী সাম্যবাদ। ভারতের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?’
‘যা কিছু শোষকশ্রেণীর স্বার্থের প্রতিকূল তাকেই তারা বলে বিদেশী, বলে অসম্ভব। চিনির কারখানা, বাষ্পীয় জাহাজ, মোটর, কাচ, ফাউন্টেন পেন ইত্যাদি জিনিসগুলো কোটি কোটি টাকা মুনাফা নিয়ে আসে। সুতরাং ওগুলো আর বিদেশী নয়। বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, চলচ্চিত্র, রেডিও এ সবই তো বিদেশের জিনিস কিন্তু এখন স্বদেশী হয়ে গেছে যেহেতু ও সবের সাহায্যে এ দেশের মানুষকে খুব ভালোভাবে শোষণ করা যাচ্ছে। অর্থাৎ শোষণের তাবৎ উপকরণ বিদেশী হলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু সাম্যবাদ যেহেতু শোষণমুখী সমাজ-ব্যবস্থা ধ্বংসকারী এক অমোস শক্তি তাই এ দেশের শাসকবৃন্দরা সব সময়েইসাম্যবাদ বিদেশী ভাবধারা এ দেশের মাটিতে চলতে পারে না–এমন একটা প্রচার তার স্বরে চালিয়ে যাচ্ছে। ওঝাজী এর নাম কি সততা!’
‘সাম্যবাদ। ধর্ম-বিরোধী আর ভারত চিরকালই ধর্মপ্রাণ-এটা ভেবে দেখেছেন?’
‘স্কুল-কলেজের শিক্ষা। আপনি বেমালুম ভুলে গেছেন ওঝাজী-আপনাকে কি করে। বোঝাতে পারি! ধর্মের কথা যখন আপনারা বলেন তখন আপনাদের মনে কেবল হিন্দুধর্মের ব্যাপারটাই থাকে। গো-সেবা মণ্ডল সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাংস ছাড়া গরুর সব কিছু খাওয়া চলবে এমন কি গোমূত্র গোবর পর্যন্ত। গান্ধীজি এই গো-সেবা মণ্ডলকে আশীৰ্বাদ জানিয়েছেন। ভারতে যদি গো-খাদক এবং গো-খাদক বিরোধীদের মধ্যে ভেদরেখা টানা হয় তবে দেখা যাবে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই গো-খাদক। আপনি তো জানেন আমাদের সম্প্রদায় গরু খায়, এর সঙ্গে যোগ করুন ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মুসলমানদের, কোটিখানেক খৃষ্টানদের এবং কয়েক লক্ষ বৌদ্ধকে। যদি গরু খাওয়া আর না-খাওয়া এতেই ধর্মধর্মের মীমাংসা হয়ে যেত তাহলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাদ দিয়ে দুনিয়ার অন্যান্য সব ধর্মাবলম্বীরা অধাৰ্মিক? গান্ধীজির ভূতপূর্ব বন্ধু লর্ড হ্যালিফ্যাক্স ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতিমান। ধর্মের জিগীর তুলে তিনি সকলকে সাম্যবাদ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ওঝাজী, শোষকশ্রেণীর সবাই দারুণ রকম ধর্মপ্রাণ এবং শোষণ-বিরোধী যে-কোনো চিন্তাধারাকেই ধর্মের শত্রু হিসাবে ঘোষণা করা হয়। হ্যাঁ, মেনে নিলাম সাম্যবাদী চিন্তাধারার জন্ম বিদেশে, কিন্তু খৃষ্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম, রেল-তার-উড়োজাহাজ-কারখানা প্রভৃতি বিদেশ-জাত বস্তু আমাদের চোখের সামনে কেমন স্বদেশী হয়ে গেছে! সাম্যবাদও অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কাছে বিদেশী ভাবধারা থাকবে না, যার প্রমাণ ইতিমধ্যেই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠছে।’
২.
পাটনায় সান্ধ্যভ্রমণের দু’টি জায়গা-বাঁকীপুর ময়দান এবং হার্ডিঞ্জ পার্ক। দুটোর অবস্থাই এমন শোচনীয় যে কাউকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা তাদের আর নেই। তবু কিছু লোক আসে, যাদের পায়ের তলায় সর্ষে অথবা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কিছুটা আড্ডা দিতে হয়। অন্ধকার ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে-তিন বন্ধুর কথা এখনও ফুরোয়নি। তিনজনে বাঁকীপুর ময়দানে চলে এসেছে। ওদেরই একজন বলল, ‘ভাই সুমের, আবার বলছি-আর একবার ভেবে দেখ। বড় ভয়ঙ্কর গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে চলেছ।’
‘মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে যাচ্ছি। তাই হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। কথাটা দেখ রূপ, এটা কোনো দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপ নয়।’
‘তুমি হাওয়ায় ভাসবে ভাই। আমার কিন্তু ঘরের ছাদের কিনারায় দাঁড়ালেই বুক ঢিবঢিব করে।‘
‘কত লোকের সাইকেল চড়তেই ভয় লাগে, আর তুমি দিব্যি চলন্ত সাইকেলে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়।’
‘একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, মজুরশ্রেণীর জন্য লড়াকু সুমের কেন এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জীবনপণ করছে!’
‘ ‘কারণ একটাই। মজুরশ্রেণীর স্বাৰ্থ এবং এই মহাযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণাম এক বিন্দুতে এসে মিলিত হচ্ছে। এই যুদ্ধ শুধু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের টানা-পোড়েন নয়, শোষকশোষিতের দ্বন্দ্বের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।’
‘এই যুদ্ধের জন্য সব চেয়ে বড় অপরাধী ইংরেজ পুঁজিপতিরা–এ কথাটা তুমি অস্বীকার করতে পার?’
‘বল্ডইউন, চেম্বারলেন যাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে তারাই যে দায়ী, এ ব্যাপারে আম তোমার সঙ্গে এক মত। কিন্তু সাম্যবাদের প্রসারকে রুখবার জন্যে ওরাই তো হিটলার মুসোলিনীকে মদত দিয়েছে, শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ভস্মাসুর শিবের বলে বলীয়ান হয়ে প্রথমে শিবের ওপরেই চড়াও হয়। এই মহাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে সেই ধরনের তামাসা ঘটতে আমরা দেখলাম। কিন্তু এখন ভস্মাসুর শিবকে ছেড়ে আমাদের দিকে থাবা বাড়িয়েছে।’