‘অবশ্যই। গরীবদের শ্রমে ফুলে-ফেপে ওঠা কিছুসংখ্যক মানুষের কর্তৃত্ব কেড়ে নিলেই আমাদের সমস্যার সমাধান সহজেই হতে পারে।’
‘সেই জন্যেই তো গান্ধীজি হাতে-তৈরি কাপড়, গুড় এবং হাতে-তৈরি সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।’
‘বটে! বিড়লা আর বাজাজের টাকার জোরে? খাদি-সংঘের দু’এক লাখ টাকা ঘাটতি পড়লেই কোনো না কোনো শেঠ এসে চেক কেটে দেয় কেন? যদি গান্ধীর চরকার দাপটে ওদের কাপড়ের কল বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হত, মুনাফায় টান ধরত কিম্বা রেশমী শাড়ির চাহিদা কমে যেত তাহলে কোনো শেঠ-শেঠানী গান্ধী-ভজনা করতে এগিয়ে আসত না–বুঝলেন ওঝাজী! এ ব্যাপারে আমার কোনো মোহ নেই।’
‘জাপানীরা থাবা বাড়িয়েছে। আপনি কি চান, তারা এ দেশের কল-কারখানা ধ্বংস করে দিয়ে যাক? কত পরিশ্রম, কত বিঘ্ন-বাধা অতিক্রম করে ভারতীয়রা এইসব গড়ে তুলেছেন-এ ব্যাপারগুলোও বিবেচনা করুন, সুমেরজী।’
‘পরিশ্রম, বিঘ্ন-বাধা এগুলো অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য। কিন্তু ব্যাপারটা কি, একদিকে গান্ধীবাদীদের বক্তব্য যে তারা কল-কারখানার অস্তিত্ব এক মুহূর্তের জন্যেও মানতে রাজী নয় অন্যদিকে এ দেশের মালিকশ্রেণী বিশ্বাস করে জাপানীরা এলেও তাদের কল কারখানার মালিকানা সুরক্ষিত থাকবে। জাপানের বেতারভাষ্য শুনে এ সম্পর্কে তাদের আস্থা বেড়ে গেছে।’
‘তারা দেশের অর্জিত সম্পদ রক্ষা করতে চায়।’
‘কটা ঘায়ে নুন দেবেন না ওঝাজী। দেশের সম্পদ না নিজেদের সম্পদের দিকে তাদের নজর? তাদের মুনাফা লুণ্ঠনের সুব্যবস্থা থাকলে ও সব কল-কারখানা ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছু আসে যায় না তাদের।’
‘মালিকদের সম্পর্কে যদি আপনার কথা মেনেও নেওয়া যায় তা হলেও গান্ধীজির সততা সম্পর্কে সন্দেহ করা আপনার উচিত নয়।’ ‘
‘কথা এবং কাজের মিল কিম্বা অমিল এর দ্বারাই আমি ব্যক্তির সততা যাচাই করি। আমি গান্ধীর দুগ্ধপোষ্য শিশু নই। এগুরুজ-ফাণ্ডের জন্য গান্ধীর পাঁচ লাখ টাকা দরকার ছিল আর বোম্বাই-এর শেঠেরা। পাঁচ দিনের মধ্যেই সাত লাখ টাকা এনে গান্ধীর চরণে সমৰ্পণ করেছিল। পুঁজিপতিশ্রেণীর জন্য তিনি যা করেছেন তাতে ইংল্যাণ্ড আমেরিকার ব্যবসায়িরা দরকার হলে সাত কোটি টাকার থলি উপুড় করে দিতে দ্বিধা করবে না!’
‘এর কারণ ব্যবসায়ী শ্রেণীর আস্থা অর্জন করেছেন তিনি।’
‘ব্যবসায়ীরা ভগবানকেও ঘুষ দেয়, তাই মন্দিরের দরজায় লিখে রাখে ‘শুভ-লাভ’।’
‘চরকা-খাদিকে এই শোষণ-ব্যবস্থার শত্রু বলে আপনার মনে হয় না?’
‘আমি চরকা-খাদি এইসব ব্যাপারগুলোকে শোষণ-ব্যবস্থা কায়েম রাখার কূটকৌশল বলেই মনে করি।’
‘তাহলে কল-কারখানাকেই শোষণ-প্রক্রিয়ার শত্রু মনে করা উচিত।’
‘তবে শুনুন, এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য। পাথরের হাতিয়ার নিয়ে যে সভ্যতা শুরু হয়েছিল আজকের মানুষ সেখান থেকে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। চরকা-র্তত সভ্যতার কোনো এক পর্যায়ে মানুষের অগ্রগতির সহায়ক হলেও আজ ওগুলো ব্যবহারিক যৌক্তিকতা হারিয়েছে। পাটনার যাদুঘরে দেখেছি। তালপাতায় লেখা পুথি। নালন্দার বিদ্যার্থীদের জন্য বইপত্তর লেখা হত তালপাতায়। ‘ফিরে চলো তালপাতার যুগে’-সাত জন্ম ধরে হেঁকে চলুন গান্ধীজি, দুনিয়া কিন্তু কলের কাগজ, মোনো টাইপ, রোটারি মেসিনে ছাপার যুগ থেকে তালপাতার যুগে ফিরে যাবে না। আর এই না যাওয়াটাই মঙ্গল। এ যেন ফ্যাসিস্ট হানাদারকদের ট্যাঙ্ক, বিমান, ডুবোজাহাজ ইত্যাদির বিরুদ্ধে পাথরের হাতিয়ার নিয়ে মোকাবিলা করতে বলছেন গান্ধীজি!’
‘আপনি দেখছি অহিংসার মহানূ সিদ্ধান্তও মানেন না!’
‘গান্ধীজির অহিংসা? ঈশ্বর রক্ষা করুন! যে অহিংসার মন্ত্রে কৃষক-মজুরদের ওপর সরকারের গুলি চালানোকে সমর্থন করা যায় আর ফ্যাসিষ্ট গুণ্ডাদের সামনে বৈষ্ণব বনে যেতে হয় তেমন অহিংসাকে বুঝে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব। চরকা-খাদির ব্যাপারে আমার বক্তব্য শুনুন ওঝাজী, মিল মালিকেরা ভালোভাবেই জানে তাদের উৎপন্ন দ্রব্য সামগ্ৰীর সঙ্গে চরকা-তাঁতের উৎপাদন কোনো দিক থেকেই প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারে না। তাই তারা মুক্তহস্তে খাদি-ফাণ্ডে খয়রাতি দিয়ে যাচ্ছে। চরকা-খাদি এই ব্যাপারগুলো হল শোষণমুখী সমাজ-ব্যবস্থার সত্যিকার শত্রু সাম্যবাদের পথে একটা বড় বাধা! কত লোক যে ভুলভাবে বুঝে বসে আছে-সাম্যবাদ এবং কল-কারখানার ওপর শ্রমিকশ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে খাদি-উদ্যোগ পন্থাই ভালো। এই ভ্ৰান্তি যাতে সহজে নষ্ট না হয় সে জন্যে মিল-মালিকেরা সব খাদি-ভক্ত হয়ে উঠেছে।’
‘আপনার বক্তব্য গান্ধী নীতির ওপর প্রত্যক্ষ আক্রমণ।’
‘গান্ধীবাদী আদর্শের প্রতিটি বক্তব্য আমাদের মতো কোটি কোটি শোষিত মানুষের কাছে মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখার, চিরস্থায়ী শোষণ-ব্যবস্থা চালু রাখার দালালদের গুদাম ঘরে আমরা চাই চিরকালের জন্যে তালা ঝুলিয়ে দিতে। আর গান্ধীজীর চেষ্টা-হল আমাদের ঠকিয়ে স্থিতস্বার্থের সেবা করা। ধনিকশ্রেণীর উচ্ছিষ্টজীবীদের যদি আমরা জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দিতে পারতাম তাহলে খুবই ভালো হত; আর তা না পারলেও তাদের রাস্তা আমরা আটকে দিতে চাই। একদিকে জাতিভেদ প্রথা অন্যদিকে শোষণ-ব্যবস্থা এই দুইয়ে মিলে ভারতবর্ষে আমাদের অস্তিত্ব বিলোপ করে দিতে চাইছে! আর গান্ধীজি উদ্ভট দার্শনিকতার সাহায্যে এ সব কিছুর ব্যাখ্যা করছেন। এই সব সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে ‘হরিজন-উদ্ধার’ নিছক ধোঁকাবাজী ছাড়া আর কি? অবশ্য এর ফলে উচ্চবর্ণের কিছু লোকের জীবিকার ভালোই ব্যবস্থা হচ্ছে।’