সুমের একুশ বছরের তরুণ, উঁচু নাক, ফর্সা রঙ, আর ঐ ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের মতো, কিছুটা শিথিল স্কুল দেহ গায়ের রঙ কালো। সুমেরের পরণে খাকি প্যান্ট, হাফসার্ট, কাঁধে বর্ষাতি, পায়ে রবারের জুতো আর ঐ ভদ্রলোকের সাদা খদ্দরের পোশাক, মাথায় গান্ধী-টুপি এবং খালি পী। সুমের কয়েক পা এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, ‘নমস্কার। জল এবার নামছে।’
‘আর বাদলা আবহাওয়াও কেটে যাচ্ছে।’
‘ক’দিন কি যে দুর্ভাবনা গেছে! এক জায়গায় পড়েছিলাম, আড়াই হাজার বছর আগে যখন পাটলিপুত্র নগরের পত্তন হয় তখন গৌতম বুদ্ধ ও তংরহের কথোপকথনে পাটলিপুত্রে। প্লাবনের কথা জানা যায়। বুদ্ধ, আগুন জল ও গৃহ-বিবাদ এই তিনটি জিনিসকে নগরের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।’
‘মনে হচ্ছে আপনি ইতিহাসের ছাত্র?’
‘না, আমি রাজনীতির ছাত্র তবে ইতিহাসের মূল গ্রন্থগুলি অনুবাদের মাধ্যমে পড়তে আমি ভালোবাসি।’
‘হ্যাঁ, জল গত কয়েকদিন ধরেই আমাদের শত্রু হিসাবেই হানা দিয়েছিল।‘
‘আগুনের ভয় তখন ছিল, যখন পাটলিপুত্রের অধিকাংশ বাড়ি-ঘর ছিল কাঠের আর ছিল শহরের আশপাশে বিপুল শালবন। অগ্নিকাণ্ড তখন প্রায়ই হত।’
‘আচ্ছা, আপনার নামটা জানতে পারি?’
‘আমার নাম সুমের, আমি পাটনা কলেজের ফিফথ ইয়ারের ছাত্র।’
‘আর আমার নাম হল রামবালক ওঝা। প্রায় কুড়ি বছর আগে আমি পাটনা কলেজের ছাত্র ছিলাম। এক বন্ধুর প্রভাবে এম, এ, ডিগ্ৰী না নিয়েই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। অবশ্য সৌজন্য আমার কোনো অনুশোচনা নেই কারণ আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি স্কুল কলেজের শিক্ষা একটা অনৰ্থকারী ব্যাপার।’
‘তবে আপনার অধীত বিদ্যা সব ভুলে গেছেন?’
‘কখনো কখনো বেমালুম ভুলে যাই। যদি একেবারে সাদা শ্লেট হয়ে যেতে পারতাম তাহলে খুবই ভালো হত-সত্যকে সুদৃঢ়ভাবে ধরে থাকা সম্ভব হত।’
‘অৰ্থাৎ আপনি বুদ্ধিমাৰ্গ ত্যাগ করে ভক্তির পথে চোখ বুজে চলতে চান?’
‘সুমেরবাবু আপনি কি ভক্তির পথকে নিন্দনীয় মনে করেন?’
‘ওঝাজী আমি বাবু নই, এক অভাজন মুচির ছেলে। জমিদারের জবরদস্তিতে বাস্তুভিটে হারিয়েছি। আমার মা কায়ক্লেশে বেঁচে আছেন মাত্র। এক সজ্জনের কৃপায় এইটুকু লেখাপড়া করতে পারছি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বাবু হবার কোনো যোগ্যতা আমার নেই।‘
‘সুমেরজী, আপনার শিষ্টাচারের এখন পর্যন্ত যে পরিচয় পেয়েছি তাতে আমি খুব খুশী। জানেন কি, গান্ধীজি তাঁর এক হরিজন শিষ্যকে আপনার মতো জীবনসংগ্রামে ব্ৰতী দেখে কি আনন্দই না পেয়েছিলেন!’
‘ওঝাজী আপনার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কথা বলতে চাই, সেজন্যে মনে হয় আমার মতামত আগেই জানিয়ে রাখা ভালো। হরিজন ‘শব্দটিকে আমি ঘৃণা করি আর ‘হরিজন’ পত্রিকাটি আমার মতে স্থিতস্বার্থের সংরক্ষক। ভারতে অন্ধকারকে স্থায়িত্ব দেওয়াই ঐ পত্রিকাটির কাজ। আর গান্ধীজিও আমার মতে জাতির ভয়ঙ্কর শত্রু।’
‘গান্ধীজি জাতির কোনো উপকার করেছেন বলে আপনি মনে করেন না?’
‘মজুরের ক্ষেত্রে কারখানার মালিক যে উপকার করে কারখানা খুলে, সেই ধরনের উপকার গান্ধীজিও করেছেন!’
‘গান্ধীজি কি শুধু মালিকদের স্বার্থেই কাজ করেছেন?’
‘জমিদার, পুঁজিপতি, দেশীয় রাজাদের ‘অভিভাবক’ বলার মানে অন্য কিছু কি হয়? আমাদের ওপর গান্ধীজির প্রীতি এই কারণেই যাতে আমরা হিন্দুসমাজের বাইরে চলে না যাই। পূণায় তিনি আমরণ অনশন করলেন–যাতে আমরা হিন্দুসমাজ ত্যাগ করে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে না তুলি। হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুদের সস্তা দাসের চাহিদা আমাদের জাতের লোকরাই যোগান দিয়েছে। আগে আমাদের দাস বলা হত, গান্ধীজি এখন ‘হরিজন’ বলে আমাদের উদ্ধার করতে চাইছেন। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের বাদ দিলে ‘হরি’ আমাদের এক বড় দুশমন। এখন ভেবে দেখুন, সেই ‘হরি’-র জন হবার বাসনা আমাদের কেন হবে!’
‘তাহলে আপনি ঈশ্বরেও বিশ্বাস করেন না?’
‘কি দরকার? হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট, অচ্ছুৎ বলে মনে করা হচ্ছে এবং সে সব চলছে ইশ্বরের নাম নিয়েই। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কথায় কথায় অবতারের জন্ম দিয়ে রথ হাঁকিয়ে চলে আর আমাদের ঘরের মেয়েদের ইজ্জৎ লুণ্ঠিত হয়। শোনপুরের মেলায় জীবজন্তু কেনাবেচার মতো আমাদের নিয়েও বেচাকেনা হয়েছে। গালাগাল, প্রহার, অনাহারে মৃত্যু-আমাদের এসব কিছুকেই বলা হয়েছে ঈশ্বরের করুণা। কিন্তু হাজার হাজার বছরের এত অত্যাচার এত দুৰ্দশা যে ঈশ্বর দেখতে পায় না-তাকে মানতে যাব কোন যুক্তিতে।’
‘আপনি কি ডাঃ আম্বেদকরের পথ পছন্দ করেন?’
‘না, তবে ডাঃ আম্বেদকরও ভুক্তভোগী। কলেজ-জীবনের প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষে আমাকেও হিন্দু ছাত্রদের হোষ্টেলে থাকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু আম্বেদকরের পথ আর কংগ্রেসের অচ্ছুৎ-নেতাদের পথের মধ্যে আমি কোনো ফারাক দেখতে পাই না। উভয়ের পথই গান্ধী-বিড়লা-বাজাজদের পথের সঙ্গে মিশে গেছে। ওঁরা এখন চাইছেন কিছু অচ্ছুৎ পাঁচ-ছ’হাজারি তনুখাওয়ালা বানিয়ে দিতে। আছুৎদের মধ্যে থেকে বিড়লা-বাজাজ না হোক, অন্তত দু-চারজন হাজারীলাল হোক। কিন্তু দু-একজন অচ্ছুৎ যদি ছোটখাট জমিদার বনে যায় তা হলেও ভারতের দশ কোটি অচ্ছুৎদের শোচনীয় অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন হবে না।’
‘আপনি চান যাতে শোষণ বন্ধ হয়–তাই না।’