ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে (১৯২১ খৃঃ) বহু রাজনৈতিক কৰ্মীসহ সফদর এবং শঙ্কর এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ফৈজাবাদ জেলে প্রেরিত হলেন। চম্পা এবং সাকিনা গ্রেপ্তার এড়িয়ে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
জেলে গিয়ে, এক ঘণ্টা নিয়মিত চরকা কাটতেন। সফদর। যারা তাঁর গান্ধী-বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের কথা জানত, তারা কটাক্ষ করত। সফদর কৈফিয়ৎ দিতেন, ‘বিলিতি কাপড় বয়কট করাকে আমি একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার বলে মনে করি; সেই সঙ্গে এও আমি জানি যে, আমাদের দেশে এখনও পর্যাপ্ত কাপড় তৈরি হয় না, তাই কাপড় আমাদের তৈরি করতে হবে। তবে দেশের কারখানাগুলি যখন পর্যাপ্ত বস্ত্ৰ উৎপাদন করবে, তখন আর চরকা কাটার পক্ষপাতী থাকব না আমি।’
জেলের ভেতর অলসভাবে বসে থাকা লোকের সংখ্যাই ছিল বেশি। এই সমস্ত লোকেরা গান্ধীজির এক বছরে স্বরাজ আনার কথায় আস্থাবান হয়ে বসেছিল। তারা মনে করত, জেলে আসাতেই তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। গান্ধীবাদী আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে তখন পর্যন্ত ভণ্ডামী, ধাপ্লাবাজী আর লোক-ঠকানো কমীিদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। কাজেই বন্দীদের মধ্যে সাচ্চা দেশভক্তের সংখ্যাই ছিল বেশি। সফদর এবং শঙ্করের আক্ষেপ হত রাজনৈতিক জ্ঞান বাড়ানোর দিকে এদের দৃষ্টি নেই বলে। এদের অনেকে রামায়ণ, গীতা বা কোরান পাঠ করত, মালা হাতে নাম জপত, অনেকে শুধু তাস পাশা খেলেই সময় অতিবাহিত করত। একদিন গান্ধীবাদী রাজনীতি দিগগজ পণ্ডিত বিনায়কপ্ৰসাদের সঙ্গে দেখা করলেন সফদর এবং শঙ্কর। বিনায়কপ্ৰসাদ বললেন, ‘রাজনীতি ক্ষেত্রে অহিংসার প্রয়োগ গান্ধীজির এক মহান আবিষ্কার এবং অমোঘ অস্ত্র।’
‘আমাদের বর্তমান অবস্থায় এটা উপযোগী হতে পারে, কিন্তু অহিংসা কোনো অমোঘ অস্ত্ৰই নয়। পৃথিবীতে যত অহিংস পশু আছে তারাই অপরের শিকার হয়।’
‘পশুকুলে না হতে পারে, কিন্তু মানুষের মধ্যে অহিংসা এক অদ্ভুত শক্তির সঞ্চার করে।’
‘নতুন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কোনো নজির থাকে না।’
‘এটা নতুন আবিষ্কার নয়।’ শঙ্কর বলে উঠলেন, ‘বুদ্ধ, মহাবীরের মতো বহু ধর্মোপদেশক এই অহিংস নীতির ওপর জোর দিয়ে গেছেন।’
‘কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়।’
সফদর, ‘রাজনীতির ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা যে কিছুটা বেড়ে গেছে তা এই জন্যেই যে, মানবতা আজ কিছুটা উচ্চস্তরে উঠেছে। সংবাদপত্রগুলিতে নিরস্ত্রদের ওপর গুলি চালাবার খবর পড়ে আজ সবাই তার নিন্দা করে। জালিয়ানওয়ালাবাগে। গুলি চালিয়ে ইংরেজরা এর প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েছে।’
‘তাহলে কি বলতে চান, অহিংসাত্মক-অসহযোগ স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়?’
‘প্ৰথমে আপনি বলুন, স্বরাজের সংজ্ঞা কি?’
‘আপনিও তো স্বাধীনতার সংগ্রামে নেমেছেন, আপনিই বলুন না!’
‘আমি মনে করি স্বরাজ মানে মেহনতকারীর রাজত্ব-শুধুই মেহনতকারীর।’
‘তাহলে আপনার স্বরাজে মন-প্ৰাণ দিয়ে, অৰ্থ দিয়ে সাহায্য করা, কষ্ট করে রাবরণ করা-শিক্ষিত পুঁজিপতি এবং জমিদারদের কোনো অধিকার থাকবে না?’
‘এ তে আপনিই দেখেছেন-পুঁজিপতি এবং জমিদারেরা সালিশী-সভা বসাতেই ফুরসৎ পায় না। ওরা জেলে আসতে যাবে কোন দুঃখো! আর যদি কেউ.এসেও থাকে। তবে শ্রমজীবীদের স্বার্থের সঙ্গে তার স্বার্থকে আলাদা করে দেখা কখনই উচিত নয়।’
শঙ্কর এবং সফদর সর্বদাই বই পড়তেন, এবং দেশের আর্থিক সামাজিক সমস্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রথম দিকে তাঁদের কথা অন্যান্যরা খুব কমই শুনত। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর (১৯২১ খৃষ্টাব্দ) মধ্যরাত্রি পার হয়ে যাবার পরও যখন জেলের ফটক খুলল না, তখন তারা নিরাশ হয়ে পড়ল। যখন আতঙ্কিত, উত্তেজিত জনতা কর্তৃক চৌরীচৌরায় কয়েকজন পুলিশের লোকের হত্যার খবর শুনে গান্ধীজি সত্যাগ্ৰহ বন্ধ করে দিলেন তখন বহু লোকই নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগল এবং তাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক এগিয়ে এসে সফদর এবং শঙ্করের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হল যে, বিপ্লবী শক্তির একমত উৎস জনসাধারণ–গান্ধীজির মস্তিষ্ক নয়। জনসাধারণের এই শক্তিকে অবিশ্বাস করে গান্ধী নিজেকে বিপ্লব-বিরোধী বলে প্রমাণ করে দিয়েছেন।
২০. সুমের (কাল : ১৯৪২ খৃষ্টাব্দ)
১৯৪২ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাস। এক নাগারে বর্ষা চলছে এবং কয়েকদিন হল সূর্যের সাক্ষাৎই মিলছে না। পাটনা শহরে গঙ্গা উজিয়ে আসছে-যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে শহরে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা। এমন আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাঁধের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখা বিশেষ জরুরী। শহরের যুবক ও ছাত্ররা গঙ্গার বাঁধ দেখা-শোনার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছে। সুমের পাটনা কলেজের এম.এ. ক্লাসের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সে দীপাঘাটের পাশে বাঁধি দেখা-শোনার দায়িত্বে রয়েছে। মাঝরাতে তার মনে হয়েছিল গঙ্গা ভীষণভাবে ফুলে উঠছে। সকালেও গঙ্গার বিশাল জলরাশিকে আটকাবার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় নি–বঁধ থেকে বিঘৎখানেক নিচ দিয়ে গঙ্গার জলরাশি প্রবাহিত হচ্ছিল। শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে আশু-বিপর্যয়ের এক গভীর আতঙ্ক। ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে হাজার হাজার মানুষ তৈরি কিন্তু সকলের মনেই গভীর সন্দেহ-গঙ্গার বাঁধকে আর এক ইঞ্চিও উঁচু করা সম্ভব। কিনা। সকাল থেকেই সুমের ব্যাকুল চিন্তা নিয়ে টহল দিচ্ছিল, দুপুরে জল কিছুটা কমতে দেখে সে স্বস্তি পেল। তার নজরে পড়ল, বাঁধের যে এলাকাটুকু সে টহল দিচ্ছিল সেখানে। এক সৌম্যমূর্তি ভদ্রলোক তার মতোই ঐ অঞ্চলে তদারকির কাজ করছিলেন। সুমেরের বেশ কয়েকবার, ইচ্ছে হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করার কিন্তু আশু-বিপর্যয়ের দুর্ভাবনা ক্লিষ্ট মন সাড়া দেয় নি। এখন জল নামছে, মেঘ সরছে, সুমেরের বাসি ইচ্ছেটা আবার জাগিয়ে উঠল।