সে রাতে তিনি লক্ষ্মেীর সর্বশ্রেষ্ঠ শ্যাম্পেন আনালেন। সাকিনা ভাবলেন, আজ কোনো’ বন্ধু আসবেন বুঝি! কিন্তু খাওয়ার পর যখন বেয়ারাকে শ্যাম্পেন খুলে আনার আদেশ সফদর দিলেন তখন সার্কিনার কিছুটা কৌতূহল হল। সাকিনার ঠোঁটে শ্যাম্পেনের গ্লাস তুলে ধরে সফ্দর বললেন, ‘সাকিনা, প্রিয়তমা, আমার কাছে এটাই তোমার শেষ প্রসাদ হয়ে দাঁড়াবে।’
‘তুমি মদ ছেড়ে দিচ্ছ?’
‘হ্যাঁ প্রিয়তমে, আরও অনেক কিছুই ছাড়ছি, কিন্তু তোমাকে নয়। এখন থেকে তুমিই। হবে আমার সুরা।’ এই কথার পর সাকিনার কাতর চেহারা লক্ষ্য করে সফদর বললেন, ‘সাকিনা আমার কাছে এস, আমরা শ্যাস্পেন পান করি এখন। আরও অনেক আলোচনাই রয়েছে আমাদের।’
সুরাপানে সাকিনার কোনোই ভাবান্তর হল না, যদিও সফদর ওমর-খৈয়াম থেকে অনেকটাই আবৃত্তি করে গেলেন। চাকর-বাকরেরা বিদায় নেবার পর সাকিনা যখন স্বামীর কাছে এসে অমঙ্গল আশঙ্কায় অভিভূত হয়ে শুয়ে পড়লেন, তখন নিজের কথা বলতে আরম্ভ করলেন সফদর–
‘সাকিনা, আমি এক গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদিও প্রথমেই আমি স্বীকার করছি যে, এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবার সময় তোমাকেও কিছু বলবার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু এই অপরাধ আমি কেন করেছি, আমার পরবর্তী কথাগুলো থেকেই সেটা বুঝতে পারবে, তুমি। সংক্ষেপে আমার সিদ্ধান্তের মূল কথা হল-আমি এখন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক হতে চলেছি।’
কথাগুলো সাকিনার হৃদয়ে এসে যেন বজ্ৰঘাত করল, আর এজন্য মুখে কিছুই বলতে পারলেন না। তিনি। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে সফদর আবার বললেন, ‘কিন্তু সাকিনা, তোমাকে আমি সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ভিতর লালিত-পালিত হতে দেখেছি, কাজেই এ কৃচ্ছ্রসাধনের মাঝে তোমাকে টেনে আনতে চাই না।’
সাকিনার মনে হল যেন আর একবার নতুন করে আঘাত লাগল তাঁর ক্ষতস্থানে-এ আঘাত যেন প্রথম আঘাতকেও ভুলিয়ে দিল। আঘাতের পর আঘাতে আত্ম-সম্মান জেগে উঠল সাকিনার, তিনি বলে উঠলেন, প্রিয়তম তুমি কি সত্যিই আমাকে এতটা আরামপ্রিয় বলে মনে কর যে, তোমাকে কষ্ট সইতে দেখেই আমি পালঙ্কের ওপর বসে থাকতে চাইব? শোন সফদার, যদি প্ৰাণ দিয়ে আমি তোমাকে ভালোবেসে থাকি, তবে সে ভালোবাসা আমাকে তোমার সঙ্গে যে-কোনোখানে যাবার শক্তি জোগাবে। অধর-রাগ অনেক ব্যবহার করেছি। আমি, বহু সময় নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছি শুধু সাজ পোশাকেই, কঠোর জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে কোনোদিনই চেষ্টা করিনি। আমি-এ সব সত্যি। কিন্তু তা হলেও তুমিই আমার সব সফদর। আমি চিরদিনই তোমার সঙ্গে থাকব। আর আমার বর্তমান জীবনের পথ প্রদর্শন যেমন তুমিই করেছিলে তেমনি আগামী জীবনেও তুমিই আবার আমার পথপ্রদর্শক হবে।’
সফদর কিন্তু এতটা আশা করেননি! যদিও তিনি জানতেন যে, সাকিনা অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মেয়ে। সফদর আবার বলতে লাগলেন, ‘নতুন মোকদ্দমা নেওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি। পুরনোগুলো অন্যের কাছে সোপর্দ করে দিচ্ছি। আশা করছি এই সপ্তাহের মধ্যেই আদালতের কাজ থেকে ছুটি পেয়ে যাব। আরও একটা খবর শুনবে সাকিনা? শঙ্করও আমার সঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপ দিচ্ছে। শঙ্কর একটি রত্ন বুঝলে সাকিনা! আমার সঙ্গে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এগিয়ে যেতে সে প্রস্তুত।’
‘শঙ্করের ত্যাগ কিন্তু তোমার চেয়েও বড় সফদর।’
‘আত্মত্যাগের জীবনই সে বরণ করে নিয়েছিল সাকিনা। এ পথ থেকে কোনোদিনই সরেনি সে। তা’না হলে খুবই বড় উঁকিল সে হতে পারত, অথবা নিজের চাকরীতেও যথেষ্ট উন্নতি করতে পারত।’
‘তার দুটি ছেলে যখন মারা যায়, তখন খুব কেঁদেছিলাম। আমি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে, চারটি থেকে দুটি বোঝা কমে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে!’
‘আচ্ছা শঙ্করের এই সিদ্ধান্তকে চম্পা কিভাবে গ্ৰহণ করবে সাকিনা?’
‘চোখ বুজে মেনে নেবে সে। স্বামীকে কি করে ভালোবাসতে হয় সেই তো আমায় শিখিয়েছে সফদর!’
‘ভবিষ্যতের থাকা-খাওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা আমাদের করে রাখতে হবে।’
‘এ সম্বন্ধে ভাববার অবকাশ পেলাম কই? তুমিই বল না কি করা যায়?’
‘আমাদের গায়ের শরীফন এবং মঙ্গলকে রেখে বাকি চাকরীদের দু’মাসের মাইনে দিয়ে বিদায় করে দিতে হবে। দু’খানা মোটরগাড়িই বেচে দেব।’
‘ভালোই হবে।’ ‘দু’একটি খাট আর কয়েকটা চেয়ার বাদে ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র বিলিয়ে অথবা নীলাম করে দিতে হবে। লাটুস রোডে মাসীর যে বাড়ি পেয়েছি, সেখানেই থাকব গিয়ে, আর এই বাংলা ভাড়া দিয়ে দেব।’
‘খুব চমৎকার ব্যবস্থা।’
‘আমার আর তো কিছুই মনে পড়ছে না!’
‘আর আমার কাপড়-চোপড়-আমার বিলিতি পোশাক পরিচ্ছদগুলো?’
‘গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিচ্ছি। তাই ওসবের কথা বলছ? আমি কিন্তু ওসব পোড়ানোর পক্ষপাতী নই, বিশেষ করে সারা দেশেই যখন প্রচুর বিলাতী জমা কাপড় পোড়ানো হচ্ছে। তবে আমার নিজের জন্যে খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবী পর্শুর মধ্যে তৈরি হয়ে আসবে।’
‘তুমি বড্ড স্বার্থপর সফদর!’
‘খদ্দরের মোটা আর ভারী শাড়ি পরবে সাকিনা?’
‘তোমার সঙ্গে সব অবস্থাতেই আমি মানিয়ে চলতে পারব।’
‘দেখি তাহলে কি করা যায়। খুব ভালো হত। যদি ঐ সব জামা-কাপড় নীলামে বিক্ৰী করে দিয়ে সেই টাকায় গরীবদের জন্য কাপড় কিনে দিতে পারতাম।’
৩.
সফদরের মতো উদীয়মান ব্যারিস্টারের এই মহান ত্যাগের কথা চতুর্দিকে আলোচিত হতে লাগল। যদিও সফদর শঙ্করকেই প্রশংসার যোগ্যতর পাত্র বলে মনে করতেন। সারা অক্টোবর এবং নভেম্বর জুড়ে সফদর জনসাধারণের মধ্যে প্রচার চালাবার সুযোগ পেলেন। কখনও কখনও সাকিনা বা শঙ্কর তাঁর সঙ্গে থাকতেন। গ্রামের দিকে তাঁর মনোযোগ বেশি, কারণ গ্রামের কৃষক-মজুরের ওপর যতটা তাঁর আস্থা ছিল লেখাপড়া-জানা শহরের লোকের ওপর ততটা ছিল না। কিন্তু এক সপ্তাহের ভেতরই তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর উচ্চশ্রেণীর উর্দু গ্রামের এক-চতুর্থাংশ লোকও বুঝতে পারছে না। শঙ্কর কিন্তু প্ৰথম থেকেই গ্ৰাম্য ভাষায় বক্তৃতা আরম্ভ করেছিলেন। তাঁর সাফল্য দেখে সফদরও ওই ভাবে বক্তৃতা দেওয়া ঠিক করলেন। প্রথমে তাঁর কথাবার্তায় পুঁথিগত শব্দই বেশি থাকত কিন্তু শঙ্করের। সাহায্যে এবং নিজের পরিশ্রমে দু’মাস যেতে না যেতেই ভুলে যাওয়া বহু শব্দ এবং সেই সঙ্গে নতুন নতুন সর্বজন-বোধ্য শব্দ তিনি রপ্ত করে ফেললেন।