‘গান্ধীর আদর্শ এবং সমস্ত কাজকে আমি বিপ্লবধর্ম মনে করি না, শঙ্কর। বিপ্লবী শক্তির ভিত্তি সাধারণ মানুষকে তিনি যে সংগ্রামে আহবান করেছেন। আমি শুধু তাঁর সেই কাজটুকুকেই বিপ্লবধর্ম বলে মনে করি। তাঁর ধর্মের দোহাই-বিশেষ করে খিলাফৎ আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর মনোভাবকে আমি বরং সরাসরি বিপ্লব-বিরোধী চাল বলেই মনে করি। কল-কারখানার যুগ ছেড়ে তাঁর অতীতে ফিরে যাবার প্রচেষ্টাকে আমি প্রতিবিপ্লবী বিচ্যুতি মনে করি। আর তাঁর স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্তকেও আমি ঐ একই পর্যায়ে ফেলি।’
‘তোমার মঙ্গল হোক সফফু ভাই। তুমি যখন গান্ধীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলে আমার তো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল তখন। আমি ভাবছিলাম, তুমিও আবার স্কুলকলেজগুলোকে শয়তানের আখড়া বলে বসবে!’
‘শিক্ষা-প্ৰণালী দোষযুক্ত হতে পারে শঙ্কর, কিন্তু আজকের স্কুল-কলেজে বসে বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমাদের। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আজ মানুষ বাঁচতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা যখনই আসুক না কেন, বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যাবেই। মানুষের ক্রমবর্ধমান ভবিষ্যৎ-সমৃদ্ধি বিজ্ঞানের ওপরই নির্ভরশীল-তাই বিজ্ঞানকে ছেড়ে অতীতের পথে পা বাড়ানো আত্মহত্যারই সামিল। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে চরকাতাঁতের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার অর্থ দেশকে সম্পূর্ণ রূপে অন্ধকার যুগে নিয়ে যাবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে বিপ্লবী সেনাদলে ভর্তি হওয়ার জন্য ছাত্রদের আহ্বান করা মোটেই অন্যায় নয়-এটা অন্তত তুমি স্বীকার করবে। শঙ্কর।’
‘নিশ্চয়। আর অন্যান্য বয়কটগুলোর বিষয়ে কি বল তুমি?’
‘আদালত বয়কট? সেটা কিন্তু ঠিকই। তার সাহায্যে আমরা বিদেশী আমাদের ক্ষমতার পরিধি এবং তীব্ৰ অসন্তোষের কথা জানাতে পারি। আর বিলিতি জিনিস বর্জন করা তো বিলিতি ব্যবসায়ীদের গালে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় মারার সামিল। তাছাড়া এতে আমাদের স্বদেশী শিল্প প্রসারের প্রেরণাও মিলবে।’
‘আমি দেখতে পাচ্ছি ভাই সফফু বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছ তুমি।’
‘এখনও যাইনি। কিন্তু আমি যেতে চাই।’
‘যেতে চাও?’
‘তুমি আগে বল আমরা এক বিপ্লবী যুগের ভিতর দিয়ে চলেছি কিনা?’
‘তোমাকে আমিই তো কতবার এ প্রশ্ন করেছি সফফু ভাই। রুশ-বিপ্লবের কথা শুনেই আমি খুঁজে-খুঁজে সাম্যবাদী-সাহিত্য পড়তে লাগলাম এবং নিজেদের সমস্যাগুলো সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করতে শুরু করলাম। এতদিন পর্যন্ত আমি শুধু এই সন্দেহের মধ্যে ছিলাম যে, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন এই মহানু উদ্দেশ্যের পরিপূরক কিনা। কিন্তু তুমি যখন বিপ্লবী জনতার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, অমনি আমার সন্দেহ দূর হয়ে গেল। গান্ধীকে আমি বিপ্লবের যোগ্য নায়ক বলে মনে করি না সফফু ভাই-তোমার কাছে খোলাখুলিই বলছি। কিন্তু জনতার শক্তির ওপরে আমি বিশ্বাস রাখি। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে। ; পদচ্যুত সামন্তগণ চর্বি, কার্তুজ আর ধর্ম বিপদগ্ৰস্ত-এই ধুয়া তুলে জনতার এক শক্তিশালী অংশকে দলে টেনে ছিল, কিন্তু আজ রুটির দাবীতেই সমগ্ৰ জনতা আন্দোলনের মাঝে এসে পড়েছে। আমার মনে হয় গণমনে উত্তেজনার এই কারণ যথার্থ, বিপ্লবের ধ্বনিটা খাঁটিইএবং গান্ধী যদি নিজের আসল ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তবুও বিপ্লবের গতি ফেরাতে সক্ষম হবেন না। তিনি!’
‘আমি ঠিক করছি যে বিপ্লবী সেনাদলে ভর্তি হব, হব অসহযোগী।’
‘এত তাড়াতাড়ি!’।
‘তাড়াতাড়ি করলে তো অনেক আগেই লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়তাম। অনেক বিচার-বিবেচনার পর আজ তোমার সঙ্গে আলোচনা করে আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেছি।’
সফদর যখন গম্ভীর স্বরে এই কথাগুলো বলছিলেন, শঙ্করের দৃষ্টি তখন কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিল। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সফদর আবার বললেন, ‘তুমি হয়ত ভাবছ, তোমার বৌদির অধর-রাগের কথা, তার রেশমী শাড়ির মখমলের পাড়টির কথা, অথবা এই বাংলা এবং তার খানসামাদের কথা! সাকিনার ওপর অবশ্য কোনো সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেব না, তার ইচ্ছামতো সে জীবনযাপন করুক। তার জন্যে তার নিজের সম্পত্তি, এবং এই বাংলা রয়েছে। কিন্তু এখন থেকে আমার কাছে এসবের আর কোনো আকর্ষণই নেই।’
‘তোমার এবং বৌদির কথাই শুধু ভাবছি না। আমি ভাবছি আমার নিজের সম্বন্ধেও। আমার চলার পথে যে মানসিক বাধা ছিল সেটা দূর হয়ে গেছে। চল আমরা দুই ভাই এক সঙ্গেই বিপ্লবের আবর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’
বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে সফ্দর বললেন, ‘অক্সফোর্ডে থাকাকালীন তোমার সম্বন্ধেই আমার ভয় ছিল শঙ্কর। এবারে তো আমি হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াব!’
সার্কিনা এসে খেতে ডাকলে দুই বন্ধুর বৈঠক শেষ হল।
২.
এই রাত থেকে সফদরকে কিছুটা প্ৰফুল্ল দেখতে পেলেন সাকিনা। তিনি ভাবলেন যে, এটা হয়ত শঙ্করের সঙ্গে গল্প-গুজবের ফল। সফদরের কাছে সব চেয়ে মুস্কিলের ব্যাপার হল নিজের সিদ্ধান্তের কথা সাকিনাকে জানানো। এমনিতে সফদরও আদর-আহ্লাদের মাঝে লালিত হয়েছে। কিন্তু তা হলেও তিনি ছিলেন গায়ের লোক। নগ্ন দারিদ্র্যাকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে তাঁর নিজের ওপর বিশ্বাস জন্মেছে যে, যে-পরীক্ষায় তিনি অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন, তাতে নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু সাকিনার কথা স্বতন্ত্র। তাঁর। সম্বন্ধে এ কথাই বলা যেতে পারে যে, পা দিয়ে কখনও কঠিন মাটি স্পর্শ করেননি। তিনি। রবিবারেও তাই সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলেন না। সফদর। সোমবার কোর্টে যখন নিকট বন্ধুদেরও তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়ে গেল, তখন সাকিনাকে সব কথা জানানোর প্রয়োজন আরও প্রবলভাবে অনুভব করলেন তিনি।