‘তুমি কি লাল লাজপৎ রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক আর বিপিনচন্দ্ৰ পাল—এঁদের কথাই বলতে চাইছ?’
‘এই লাল, বাল, পাল-এঁরা ছিলেন বহির্বিশ্বের ঘটনাবলীর প্রতীক। রাশিয়াকে পরাভূত করে (ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪) জাপান নিজেকে বৃহৎ শক্তিসমূহের পর্যায়ভুক্ত করে। ফলে কংগ্রেসের অস্পষ্ট বক্তৃতার জড়তা ভেদ করে ভারতীয় যুবকদের সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জোগায়। অর্ধশতাব্দী পর ভারতীয়গণ নিজেদের জন্য মরতে শিখল, এ বিষয়ে। আয়ার্ল্যাণ্ড এবং রাশিয়ার শহীদদের উদাহরণেও অনুপ্রাণিত হলাম আমরা। কাজেই বর্তমান ঘটনাবলীর কারণগুলির অনুসন্ধান শুধু ভারতবর্ষের ভেতর থেকে করতে গেলে ভুল হবে না কি?’
‘নিশ্চয়ই, দুনিয়ার সকল জায়গাই যে পরস্পর সম্বন্ধ যুক্ত।’
‘কোনো বিপ্লবী আন্দোলনের শক্তি নির্ভর করে দুটো বিষয়ের ওপর। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তথা আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্তসমূহ থেকে কতটা প্রেরণা লাভ করল এবং সে দেশের সবচেয়ে সংগ্রামী শ্রেণী কতটা পরিমাণে অংশগ্রহণ করল। প্রথম উৎসের উদাহরণ আমি দিয়েছি। দ্বিতীয় উৎস হল, মজুর-কৃষক জনগণ। বিপ্লবী-যুদ্ধ সেই চালাতে পারে-হারাবার মতো যাদের কিছু নেই। সাকিনার অধীর-সুধা, এই বাংলো এবং গাঁয়ে পৈতৃক জমিদারী হারাবার ভয় যাদের আছে বিপ্লবের সৈনিক সে হতে পারে না। এই জন্যই বলছিলাম যে, সর্বহারা জনতাই শুধু বিপ্লবের বাহন হতে পারে।’
‘এ বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে একমত।’
‘তাহলে জনতার অন্তরে যে উত্তেজনা আজ রয়েছে তাকে উপলব্ধি কর, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে কতটা প্রেরণা পাওয়া যাচ্ছে সে সম্বন্ধেও চিন্তা করে দেখ। গত মহাযুদ্ধ গোটা পৃথিবীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে! সে যুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধপুঁজি এবং উৎপাদিত পণ্যের সুরক্ষিত বাজার দখলে রাখবার বা বলপূর্বক অধিকার করতে যাবার পরিণাম। জার্মানীর ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের সুরক্ষিত বাজারের জন্যে নতুন উপনিবেশ প্রয়োজন ছিল, কিন্তু পৃথিবী বণ্টন করা হয়েছিল আগে থাকতেই। তাই যুদ্ধ করেই উপনিবেশ ছিনিয়ে নেবার প্রয়োজন হল, আর উপনিবেশগুলির মালিক ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধিল জার্মানীর। যুদ্ধে জার্মানী হেরে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সাম্রাজ্যবাদের স্বপ্ন চুরমার করে দেবার জন্য অপর এক শত্রু জন্মলাভ করল-যার নাম সাম্যবাদ। সাম্যবাদের শাসনাধীনে উৎপাদন মুনাফাশিকারের যন্ত্র নয়, পরন্তু মানব সমাজকে সুখী এবং সমৃদ্ধ করে তোেলবার উপাদান। যন্ত্রের ক্রমোন্নতি সাধিত হয়, কলকারখানা প্রসার লাভ করে, পণ্য উৎপাদন বেড়ে যায় এবং তার জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত বাজারের। আবার ঐ সব পণ্য ক্রয় করার জন্য অর্থেরও প্রয়োজন হয় যার জন্য ক্রেতার পুরো মজুরী লাভের সুযোগ থাকা উচিত। ক্রেতার আর্থিক সঙ্গতি যত কম থাকবে, পণ্যও সেই পরিমাণে অবিক্রীত পড়ে থাকবে বাজারে বা গুদামে। পণ্য উৎপাদন কমিয়ে দিলে কারখানা বহুলাংশে বন্ধ হয়ে যাবেই, মজুরেরা বেকার হয়ে পড়বে, মাল খরিদ করবার মতো পয়সাও তাদের হাতে থাকবে না। লোকে তখন মাল খরিদ করবে কি করে, কি করে কারখানাই বা চালু থাকবে। সাম্যবাদ বলে, মুনাফার বাসনা ত্যাগ কর। নিজ রাষ্ট্র বা সমগ্র পৃথিবীকে একক পরিবার বিবেচনা করে তার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন কর, প্ৰত্যেকের কাছ থেকে তার সামর্থ্যানুযায়ী শ্ৰম আদায় কর, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার জীবন ধারণের উপযোগী আবশ্যকীয় সামগ্ৰী দাও। অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত সকলের প্রয়োজন মেটাবার মতো কল-কারখানা এবং কারিগর সৃষ্টি না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমের পরিমাণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক দাও। আর এই ব্যবস্থা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু থাকবে. না, কারখানা এবং সমগ্র উৎপাদন যন্ত্রের ওপর থেকেই ব্যক্তির একচেটিয়া অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
‘এ রকম কল্পনা সত্যই সুন্দর।’
‘এখন এ শুধু কল্পনা নয় শঙ্কর, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ। রাশিয়ায় ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে ৭ই নভেম্বর সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পুঁজিবাদী দুনিয়া অবশ্য আজও মানবতার এই একমাত্র আশা-ভরসার স্থলকে নির্মূল করতে চাইছে কিন্তু সোভিয়েত সরকার প্রথম অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, অবশ্য হাঙ্গেরীতে মাত্র। ছ’মাস পরে (মার্চ-আগষ্ট, ১৯১৮) ফ্রান্স এবং আমেরিকার পুঁজিপতিগণের সাহায্যে এই সোভিয়েত শাসনকে নিশ্চিহ্ন করে। ফেলা হয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়ায় মজুর-কৃষক রাজের অস্তিত্ব সমগ্র দুনিয়ার সামনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আর এই সোভিয়েত শাসন কায়েম করেছে যে বিরাট শক্তি তা সমস্ত দেশেই কাজ করে চলেছে। যুদ্ধ থেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজরা রাউলাটবিল পাশ করবার জন্য এত তাড়াহুড়া করেছিল। কেন?–এই বিশ্ববিপ্লবী শক্তিকে দমন করার জন্য। যদি ঐ বিপ্লবী শক্তি পৃথিবীকে রূপান্তরিত করবার জন্য দেশে তার বীজ বপন না করত, তাহলে ইংরেজরা রাউলাট বিল পাশ করত না আর গান্ধীও তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেন। না। সেই সঙ্গে ১৮৫৭-র পর থেকে চাপা পড়ে থাকা আগুন সারা দেশে জ্বলে উঠত না। এই জন্যই আমি বলছি, আমরা এক বিপ্লবী যুগে এসে পড়েছি।’
‘তাহলে তোমার মতো গান্ধী বিপ্লবী—নেতা? কিন্তু যে গান্ধী গোখেলের মতো উদারনৈতিক নেতাকে নিজের গুরু বলে মনে করেন, তিনি কি করে বিপ্লবী নেতা হতে পারেন সফফু ভাই?’