‘তুমি কি মনে কর ভারতের রাজনৈতিক ঘটনাবলীও এ সবের সঙ্গে জড়িত?’
‘রাজনৈতিক ঘটনাই শুধু নয়, আমাদের ইংরেজ শাসকবৃন্দের ভারত-সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণেও এর প্রভাব বিদ্যমান। ইউরোপে জার্মানীর মতো এক দুর্জয় শক্তির উদ্ভব হতেই ফ্রান্স আর ইংলন্ডের প্রতিদ্বন্দ্ব রইল না। কারণ জার্মানী থেকেই এখন তার যত বিপদের আশঙ্কা। মৃত প্যারী-কমুন এবং ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে অষ্ট্রিয়া বাদে জার্মানীর সকল রাষ্ট্রের মিলিত এক জীবন্ত যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রাজতান্ত্রিক শাসকবৃন্দের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল—এ! কথা আর বলার দরকার হয় না। একই সঙ্গে এই সময় আরও পরিবর্তন ঘটল। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ড সামান্য ব্যবসায়ী থেকে পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হল। কাঁচামাল কেনা থেকে আরম্ভ করে উৎপাদিত পণ্য বাজারে ছাড়া পর্যন্ত সকল পর্যয়েই মুনাফা-শিকারের একচেটিয়া ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। ব্যবসাতে শুধু কারিগরদের কাছ থেকে মাল খরিদ করে এদিক-সেদিকে বেচে লাভ হয়। কিন্তু পুঁজিবাদে প্রতিটি পদক্ষেপেই লাভ। তুলা কিনতে গিয়ে লাভ, পরিষ্কার করিয়ে বস্তা-বন্দী করাতে লাভ, রেলে এবং জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে যেতে পারলে লাভ, ম্যানূচেস্টারের মিলে সুতো-কাটা এবং কাপড় বোনায় লাভ, আবার তৈরি কাপড় জাহাজে করে ফিরিয়ে আনতে, জাহাজ কোম্পানী থেকে লাভ, রেলের লাভ—এই সমগ্র মুনাফার তুলনা করে কারিগরের হাতে বোনা মাল বিক্রি করা ব্যবসায়ীদের। লাভের সঙ্গে!’
‘হ্যাঁ ব্যবসা থেকে পুঁজিবাদে লাভ তো নিশ্চয়ই বেশি।’
‘১৮৭১ খৃষ্টাব্দে যখন ভার্সাইতে বিজয়ী জার্মানী গ্রুশিয়ার রাজা প্রথম ইউলিয়ামকে সমগ্র জার্মানীর কাইজার (সম্রাট) বলে ঘোষণা করল, তার পরের বছর (১৮৭২) ফোঁপে ওঠা ইংরেজ পুঁজিপতিরা টোরি প্রধানমন্ত্রী ডিস্রেইলীর মারফৎ সাম্রাজ্যবাদ ঘোষণা করল। এই ঘোষণা শুধু নতুন শব্দ নয়–খুবই সুচতুর তার লক্ষ্য এবং অভিসন্ধি। কল কারখানাও এত বেড়ে উঠেছিল যে, তার জন্য সুরক্ষিত বাজারের প্রয়োজন ছিল। এমন বাজার, যেখানে জার্মানী এবং ফ্রান্সের তৈরি মালের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভয় নেই। অর্থাৎ যে-সব বাজারের ইজারাদারী সম্পূর্ণ নিজের হাতের মুঠোয় থাকবে। এরই সঙ্গে সঙ্গে পুঁজি ও এতটা ফোঁপে উঠেছিল যে, তাকে মুনাফা-মৃগয়ায় খাটাবার জন্যও প্রয়োজন হল সংরক্ষিত স্থানের। আর এই সব কার্যসিদ্ধি অপর দেশকে সম্পূর্ণরূপে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে পারলেই হতে পারে। ডিস্রেইলীর অভিধানে এই সবই ছিল সাম্রাজ্যবাদ শব্দের অর্থ। ভারতবর্ষে এই দুই বিষয়েই সুবিধা ছিল, আর ইউরোপ থেকে ভারতে আসবার সবচেয়ে সস্তা এবং সহজ পথ ছিল সুয়েজ খাল-১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে যার খননকার্য শেষ হয়েছিল। ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে মিশরের কাছ থেকে ১,৭৭,০০০ শেয়ার চল্লিশ লক্ষ পাউণ্ড দিয়ে টেলিগ্রামে কিনে নিল ডিসরোইলী সাম্রাজ্য-বিস্তারে এটা হল তার দ্বিতীয় পদক্ষেপ। তারপর ১৮৭৭–এর ১লা জানুয়ারি দিল্লীতে দরবার বসিয়ে রাণী ভিক্টোরিয়াকে সম্রাজ্ঞী রূপে ঘোষণা করে ডিস্রেইলী সাম্রাজ্যবাদকে এত দূর এগিয়ে নিয়ে গেল যে, উদারনৈতিক দলের গ্র্যাডক্টোন প্রধানমন্ত্রী হয়েও ডিস্রেইলীর নীতি পরিবর্তন করতে সমর্থ হল না।’
‘আমরা এখনও ছাত্রদের পড়াই যে, মহারাণী ভিক্টেরিয়া ভারতসম্রাজী-কাইজার-ই–হিন্দ উপাধি ধারণ করে ভারতবর্ষকেই ধন্য করেছেন।’
‘ছ’বছর আগে প্রশিয়ার রাজাও এই কাইজার উপাধি ধারণ করেছিল। রোমান সম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে পরিত্যক্ত শব্দের মূল্য হঠাৎ কেমন বেড়ে উঠল!’
‘রোমান শব্দ ‘কাইজার’কে শুধু ভারতবর্ষেই ব্যবহার করা আর ইংরেজিতে তার জায়গায় ‘এমূপ্রেসূ ব্যবহার করা-এর ভেতর আবার রহস্য নেই তো কোনো?’
‘থাকতে পারে! যাইহোক, ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে আমরা সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবিষ্ট হয়েছি। প্রথমে এল ইংলণ্ড। পরাজিত প্রজাতান্ত্রিক ফ্রান্স নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে তুসিনের (আফ্রিকা) ওপর অধিকার কায়েম করে সাম্রাজ্যবাদের পথ ধরল। আর নতুন ফ্যাক্টরী এবং পুঁজিপতিদের দ্বারা সমৃদ্ধ জার্মানীও ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে উপনিবেশের দাবী উত্থাপন করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর হল।’
‘কিন্তু ভারতে ইংরেজের নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর কি সম্বন্ধ?’
‘নিত্য-নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্র, ক্রমবর্ধমান কল-কারখানা এবং সেগুলি থেকে উৎপাদিত পুঁজির জন্য মৃগয়াক্ষেত্রের ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। ১৮৭৪-৮০ খৃষ্টাব্দের ভিতর ডিস্রেইলী মন্ত্রীসভা সেটা সম্পাদন করে ফেলল। ১৮৮০-৯০ খৃষ্টাব্দের উদারনৈতিক গ্লাডক্টোন সরকারও ডিস্রেইলীর পথ থেকে পশ্চাদপসরণ করতে সমর্থ হল না। পুঁজির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী দানবতাকে কিছুটা ভদ্রবেশ পরাবার প্রয়োজন ছিল, যাতে জনসাধারণ সতর্ক হয়ে উঠতে না পারে। এই জন্যই ডিস্রেইলী ‘ভারত সম্রাজ্ঞীর অভিনয়ের অবতারণা। করেছিল। এরপর প্রয়োজন হল। উদারনৈতিকদের আরও কিছুটা উদারতা দেখানো। এই উদারতা নেমে এল আয়ার্ল্যাণ্ডের ‘হোম রুল’ রূপে। কিন্তু আয়ল্যাণ্ডের প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। ভারতীয়রা ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে নিজেদের কংগ্রেসকে দীড় করাল। কংগ্রেস বস্তুত ব্রিটিশ উদারনৈতিক দলের ধর্মপুত্র রূপেই জন্মলাভ করল এবং এক যুগ পর্যন্ত আপন ধর্ম পুত্রকে ব্রিটিশরা সস্নেহে রক্ষা করল। কিন্তু ১৮৯৫ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত ব্রিটেনে পুনরায় টোরি সরকার প্রতিষ্ঠিত হল, তারা এলগিন এবং কার্জনের মতো সুযোগ্য সন্তান ভারতবর্ষে পাঠাল সাম্রাজ্যবাদের ভিত সুদৃঢ় করতে। কিন্তু ফল হল উল্টো।’