এ-কথা সে কথা করে দুটো চারটি কথাবার্তার পরই সোনালী ধান-রঙের শাড়ি এবং লাল ব্লাউজ পরিহিতা সাকিনা এসে হাজির হলেন।
শঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নমস্কার বৌদি!
মৃদু হেসে নমস্কার’ বলে জবাব দিলেন বৌদি। ধনী ‘স্যার’-এর গ্রাজুয়েট দুহিতা সাকিনা কোনো দিনই পর্দার আড়ালে থাকেননি, কাজেই শঙ্কর সিংহের সামনে আসা বা না-আসার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সফন্দরের সঙ্গে শঙ্করকে নিঃসঙ্কোচে, কথাবার্তা বলতে। দেখলেই বিয়ের পর প্রথম মাস ছয়েক পর্যন্ত ত্ৰু কুঁচকে থাকত সাকিনার। পরিশেষে সফদরের কাছে তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে যে, শঙ্কর বাস্তবিকই স্নেহ-সম্মানের পাত্র। বর্তমানে তো শঙ্করের সঙ্গে সাকিনার খাঁটি দেওর-বৌদির সম্পর্ক। সাকিনা নিজেকে স্বেচ্ছায়ই সন্তানহীন করে রেখেছিলেন, কিন্তু মাঝে-মাঝে তিনি শঙ্করের শিশুপুত্রকে কাছে এনে রাখতেন।
এ দিকে গত ছ’বছর থেকে শঙ্কর বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর ওপর ভগবান শঙ্করের কৃপা অসীম। তাঁর ঘরে দু’বছরের কম বয়সের কোনো না কোনো শিশু সব সময়েই রয়ে। যাচ্ছে বিগত ছ’বছরে।
গত এক সপ্তাহ ধরে সফদরের অস্বাভাবিক গভীৰ্য সাকিনাকে চিন্তিত করে তুলেছিল। আজকে শঙ্করকে দেখে বড়ই খুশী হলেন। কেননা তিনি জানতেন যে, সাহেবের মনের ভার লাঘব করতে একমাত্র শঙ্করের সাহায্য প্রয়োজকন, তাঁর দিকে তাকিয়ে সাকিনা বললেন, ‘ঠাকুরপো, তোমার তাড়া নেই তো? বৌদির হাতের চকোলেট পুডিং কেমন লাগবে?’
সফদর, ‘এ আজ জিজ্ঞেস করবার দরকার কি?’
সাকিনা, ‘আমি জেনে নিতে চাই ঠাকুরপো কখন যাবেন। তাঁর চলে যাবার তো কোনো ঠিক নেই!’
শঙ্কর, ‘এমন কথা বল না বৌদি! কখনো তোমার হুকুম অমান্য করেছি?’
সাকিনা, ‘কিন্তু হুকুম শোনার আগে সরে পড়া সেও তো এক অপরাধ।’
শঙ্কর, ‘আচ্ছা তাহলে খাবার এবং পুডিং খেয়ে যেতে হবে তোমাকে।’
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন সাকিনা। সফদর এবং শঙ্করের বাক্যালাপও ক্রমশ গুরুতর–বিষয়ে প্রবেশ করল। সফদর বললেন, ‘সম্পূর্ণ নতুন এক বৈপ্লবিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। শঙ্কর। আমার মতে ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের পর এই প্রথম সমগ্ৰ ভারতভূমির ভিতসুদ্ধ টলমল করে উঠেছে।’
‘সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা বলতে চাইছ?’
’রাজনৈতিক আন্দোলন কথাটা অত্যন্ত সাধারণ, শঙ্কর। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে কংগ্রেস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সেটা ইংরেজ আই-সি-এস সাহেবদের অবসর বিনোদনের প্রতিষ্ঠান ছিল, তখনও কংগ্রেসের বড়দিন-উৎসবের বক্তৃতা এবং সুরাপানকে ‘আন্দোলন’ আখ্যাই দেওয়া হত। তুমিও যদি তাকে আন্দোলন বলতে চাও তো আমি বলব, আন্দোলনের যুগ থেকে আমরা এখন বিপ্লবের যুগে প্রবিষ্ট হয়েছি।’
‘যেহেতু গান্ধীজি তিলক-স্বরাজ ফাণ্ডের জন্য এক কোটি টাকা তুলেছেন এবং ২ স্বরাজের দাবী নিয়ে খুব হৈ-চৈ শুরু করেছেন-এই জন্যে?’
‘কোনো এক বিশেষ ব্যক্তি বিপ্লব অথবা বিপ্লবী আন্দোলনের আধার হতে পারে না শঙ্কর। যে বিরাট পরিবর্তন বিপ্লব বয়ে আনে, তাও এক-আধা ডজন মহাপুরুষের সামর্থের বাইরে। আজকের এই আন্দোলনের মূল কারণ যখন আমি বিশ্লেষণ করি, তখন এই সিদ্ধান্তেই আমাকে পৌঁছাতে হয়। তুমি তো জানো শঙ্কর, ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা ছিল পদচ্যুত সামনবতপ্রভুরা, কিন্তু সে যুদ্ধ চলেছিল সাধারণ লোকেরই প্রাণের বিনিময়ে। আমাদের দুর্বলতার জন্য আমরা সফল হতে পারিনি সে যুদ্ধে, পরাজিতদের ওপর কঠোর প্রতিশোধ নিল ইংরেজরা। সে যাক, আমি বলতে চাই যে, ১৮৫৭ সালের পরে এই প্রথম দেশের সমগ্র জনসাধারণকে স্বাধীনতার যুদ্ধে একতাবদ্ধ করা হয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসের একজন কৃতী ছাত্র হয়ে তুমিই বল, এমন আর একটিও আন্দোলনের কথা কি তোমার জানা আছে, যাতে জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে?’
‘ভাই সফদর, নাগপুর কংগ্রেস (১৯২০ খৃঃ) এবং কলকাতা কংগ্রেস শেষ হয়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে যে উত্তেজনার কথা তুমি বলছি, তা আমিও নিজের চোখেই দেখেছি এবং তাকে অভূতপূর্ব বলেই স্বীকার করি। কিন্তু প্ৰচণ্ড এই ঝড়ের পর, এই লক্ষ্মৌতেই বহুবার বিদেশী কাপড়ের স্তুপ পোড়ানোর পরও যা তোমার মনে বিশেষ কোনো রেখাপাত করেনি। সেই ব্যাপারেই আজ তুমি এমনভাবে কথা বলছি যেন এক আসন্ন বিপ্লবের সঙ্গে তুমি ভীষণভাবে জড়িত।’
‘তোমার কথা ঠিকই শঙ্কর। সত্যিই এই বিপ্লবের ঢেউ যেন দেহ থেকে আমার পাদুটোকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। কিন্তু এই বিপ্লব-তরঙ্গকে ছোট রকমের এক স্থানীয় ঘটনা বলে আমি মনে করি না। বরং এ এক বিরাট গণ অত্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েই উঠেছে। সমস্ত যুগেই সবচেয়ে বড় বিপ্লবী শক্তি জনগণকে আশ্রয় করেই প্রকট হয়ে ওঠে।’
‘১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ থেকে আরম্ভ করলে ভাই, মস্ত বড় জল ছড়িয়ে বসছ যে!’
‘ও কথা কেন, আমার বক্তব্য শুনবে কি শঙ্কর?’
‘ব’ল, আমি শুনিব। বৌদি পুডিং তৈরি করছেন, আর কোল রবিবার। শুধু কেউ গিয়ে বাড়িতে খবর দিয়ে এলেই হল যে, শঙ্কর এই লক্ষ্মৌতে বেঁচেই আছে এবং তার বৌদির হাতের পুডিং খেয়ে নাক ডাকাচ্ছে। ব্যসূ তারপর সারারাত ধরে নিশ্চিন্ত হয়ে তোমার কথা। শুনতে পারব আমি।’
‘শঙ্কর শুধু আমিই নই, ভারতের বাইরে সমস্ত জায়গায় রাজনীতির ছাত্ররা স্বীকার করে যে গত শতাব্দী এবং বর্তমান শতাব্দীতে ইংলণ্ডের রাজনীতিতে সকল পরিবর্তনই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত, এবং নিয়ন্ত্রিত হয়েছে পৃথিবীর অপরাপর রাজশক্তির গতিবিধি দ্বারা। আর এই সব পরিস্থিতির কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর-মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। ১৮৫৭-র ঢেউ চলে যাবার পর আমাদের দেশ ঘুমিয়ে পড়েছিল একেবারে। অর্থাৎ আমাদের গতি তখন এত শ্লথ যে, তাকে ঐ ঘুমিয়ে-পড়া আখ্যাই দিতে হয়, কিন্তু অন্যান্য দেশে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়ে গেল। এক হাজার বছর আগে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে খণ্ড-বিখণ্ডিত ইটালী ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে (২রা এপ্রিল) একটি যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হল, এবং ম্যাজিনী গ্যারিবাড়ীর মতো মহান আদর্শ আমাদের উপহার দিল। রোমান সাম্রাজ্যকে বিধ্বস্ত করতে সমর্থ হলেও যে জার্মান জাতি নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি, ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে তারা আংশিকভাবে এবং ফ্রান্স বিজয়ের পর ১৮৭০-এ (১৮ই জানুয়ারি) প্রায় সম্পূর্ণভাবে গ্রুশিয়ার নেতৃত্বে একটি যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের এই সব পরিবর্তন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরাট পরিবর্তন। এরপর, ফ্রান্সের বিশাল শক্তিকে ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে পরাস্ত করে প্যারিস এবং ভার্সাই-এর ওপরেও জার্মানী তার ধ্বজা ওড়াতে পেরেছিল, যার ফলে ইংলণ্ড এবং রাশিয়া। ভীত হয়ে বার্লিনের ওপর লক্ষ্য রাখতে লাগল। এটা তো হল বৈদেশিক শক্তিতে ভীতির ব্যাপার। কিন্তু এর চেয়েও বড় ভয় তাদের হল প্যারীর শ্রমিক রাজ্য প্যারী—কমুনকে দেখে-দোসরা এপ্রিল থেকে যে দেড় মাসের কিছু বেশি টিকে ছিল এবং প্রমাণ করে দিয়েছিল, শুধু জমিদার পুঁজিপতিরাই নয়, শ্রমিকরাও রাজ্যশাসন করতে সক্ষম।’