বিন্দী সিংহ, দেবরাম সদাফল পাণ্ডে, রহিম খাঁ ও গুলাম হোসেন-মীরাটের এই পাঁচজন সিপাহী মঙ্গল সিংহের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিল। যখন গঙ্গার দুদিক থেকে তার নৌকা আক্রান্ত হল, তখন বন্দী ইংরেজ নর-নারীদের অনুরোধে ইংরেজ জেনারেল ক্ষমা ঘোষণা করে শর্ত দিল যে, মঙ্গল সিংহ আত্মসমৰ্পণ করুক, কিন্তু মঙ্গল সিংহ গুলি চালিয়ে ইংরেজদের শর্ত প্রত্যাখ্যান করল। অবশেষে ছটি মৃদতেহ নিয়ে গঙ্গার বুকে ভাসমান মঙ্গল সিংহের নৌকা ইংরেজদের হাতে বন্দী হল। ইংরেজেরা সেদিন ভারতীয় বীরত্বের প্রতি অভিবাদন জানাল।
১৯. সফদর (কাল : ১৯২২ খৃষ্টাব্দে)
ছোটো সুন্দর বাংলো। বিশাল প্রাঙ্গণের এক ধারে লাল এবং গোলাপী রঙের বড় বড়। ফুল ফুটেছে। একদিকে ব্যাডমিন্টন খেলার ছোট লন। লনের সযত্ন-লালিত সবুজ ঘাসগুলোর ওপর হেঁটে বেড়ানোও এক আনন্দের বস্তু। তৃতীয় দিকে এক লতামণ্ডপ এবং চতুর্থ দিকে বাংলোর পেছনে খোলা বারান্দা, সন্ধ্যার সময় সফদর প্রায়ই সেখানে বসতেন।
বাংলোর বাইরের দেয়ালের প্রাচীর বেয়ে সবুজ লতা উঠেছে। সফদর সাহেব অক্সফোর্ডে এমনি এক লতামণ্ডিত গৃহ দেখেছিলেন, নিজের বাংলোর প্রাঙ্গণে মনোরমভাবেই এগুলোকে লাগিয়েছেন।
এ ছাড়া তাঁর দুটো মোটর গ্যারেজও রয়েছে। সফদর জঙ্গ-এর সব কিছুতেই হুবহু ইংরেজি ঢঙ। আধা ডজন চাকর-বাকর তীর-ইংরেজ অফিসারের চাকরীদের মতোই তাদের সব আদব-কায়দা। কোমরে লালপট্টি, আঁটো করে বাঁধা পাগড়িতে নিজ সাহেবের নাম-চিত্র (মনোগ্রাম)। খাওয়ার ব্যাপারে বিলিতি খানাই ছিল সফদর সাহেবের সবচেয়ে প্রিয় এবং খানসামাও সে জন্য রাখা হয়েছিল তিনজন।
সফদর তো সাহেব ছিলেনই, সাকিনাকেও চাকর-বাকর মেমসাহেব বলে ডাকত। সাকিনা ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রুর অতিরিক্ত লোমরাজি কামিয়ে ফেলে আরও সূক্ষ্ণ করে নিয়েছিলেন এবং কলপ দিয়ে সেই বঙ্কিম ভ্রূ হয়েছে আরও সুন্দর। পনের মিনিট অন্তর লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙানো তাঁর অভ্যাস–তবে বিলিতি মেয়েদের পরিচ্ছদ কখনই পছন্দ করতেন না সাকিনা।
গত বছর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সফদর সাহেব বিলেত যান। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে, সাকিনাও স্কার্ট-পেটিকেট। পরেন। সাকিনা কিন্তু এতে রাজী হননি। আর বিলেতের নর-নারীরা। সাকিনার সৌন্দর্যের সঙ্গে তাঁর বেশভুষারও যে রকম তারিফ করেছিল, তাকে সফদরের অম্লার কোনো আফসোশ ছিল না। স্বামী-স্ত্রী দুজনের গায়ের রঙই এত পরিষ্কার যে, ইউরোপে সবাই তাঁদের ইতালীয়ান মনে করত।
১৯২১-এর শীতকাল। উত্তর ভারতের সমস্ত শহরের মতো লক্ষ্ণৌতেও শীতকালটাই সবচেয়ে সুন্দর। সফদর সাহেব আজ কাছারী থেকে ফিরেই বাংলোর পিছনের বারান্দায় বেতের চেয়ারে এসে বসেছেন। তাঁর মুখমণ্ডল আজ অপেক্ষাকৃত গভীর। সামনের ছোট টেবিলের ওপর তাঁর নোটবুক এবং আরও দু-তিনখানা বই রয়েছে। পাশে তিনখানা খালি চেয়ার। সফদারের পরনে কড়া ইস্ত্রী করা প্রথম শ্রেণীর ইংরেজি সুট। তাঁর গোফদাড়ি-বিহীন। মুখের এই সময়কার চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সাহেব আজ কোনো গরুগম্ভীর চিন্তায় মগ্ন। এই সময় চাকর-বাকরেরা খুব কমই আসত মনিবের সামনে। এমনিতে সফদর সাহেব মোটেই রাগী নন তবে চাকর-বাকরেরা ধরে রেখেছিল যে, এ রকম সময় সাহেব একলা থাকতেই ভালোবাসেন।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিন্তু সফদর ঐ একই আসনে বসে রয়েছেন। একজন চাকর টেবিল ল্যাম্প এনে রাখল সামনে। বাংলোর দিক থেকে কার যেন আসার শব্দ পেলেন। সফদর। চাকরকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, ‘মাস্টার শঙ্কর সিংহ ফিরে যাচ্ছেন।’
দৌড়ে গিয়ে মাস্টারজীকে ডেকে আনবার আদেশ দিলেন সফদর।
মাস্টার শঙ্কর সিংহের বয়স এই ত্রিশ-বত্রিশ, কিন্তু ইতিমধ্যেই বার্ধক্যের ছাপা পড়ে গেছে। তাঁর চেহারায়। তাঁর গলাবন্ধ কালো কোট, পায়জামা, মাথায় গোল ফেল্ট-টুপি, ঠোঁটের ওপর ঝুলে-পড়া ঘন কালো গোফে তারুণ্যের কোনো চিহ্নই নেই। যদিও তাঁর উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টিতে প্রতিভা ফুটে ওঠে।
মাস্টারজী পৌঁছাতেই সফদর উঠে তাঁর হাত ধরলেন এবং চেয়ারে বসিয়ে বললেন, ‘শঙ্কর, দেখা না করেই ফিরে যাচ্ছিলে?’
‘ক্ষমা কর ভাই সাহেব, ভেবেছিলাম তুমি কোনো কাজে ডুবে রয়েছ।‘
‘মোকদ্দমার দলিলপত্রে একেবারে ড়ুবে থাকলেও আমার কাছে তোমার জন্য দু’মিনিট সময় সর্বদাই থাকে, আর আজ তো কোনো দলিলপত্রও নেই!’
শঙ্কর সিংহের প্রতি সফন্দরের নিবিড় স্নেহ ছিল, অপর কাউকে তিনি তার চেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে করতেন না। সৈয়দপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে লক্ষ্মৌতে বি. এ. পাশ করা পর্যন্ত দুজনেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরীক্ষায় কখনও কেউ দু’চার নম্বর বেশী পেতেন, কখনও বা কম। কিন্তু যোগ্যতার এই প্রতিদ্বন্দিতার ফলে তাঁদের মধ্যে কখনও ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি। একটি ব্যাপারে দু’জনের বন্ধুত্বকে নিবিড় করে তুলতে। সাহায্য করেছিল-তাঁরা দু’জনেই ছিলেন গৌতম-রাজপুত বংশের সন্তান। একজনের পরিবার আজ হিন্দু আর অন্যজন মুসলমান কিন্তু দশ পুরুষ আগে এই দুটো পরিবার শুধু যে হিন্দু ছিল তাই নয়, উপরন্তু দুটো বংশই পূৰ্বজে গিয়ে মিলে যেত। বিশেষ বিশেষ কারণে সংঘটিত পরিবারিক মিলন-সভাগুলোতে এখনও দুই পরিবারের লোককে একত্রিত হতে দেখা যেত।
সফদর পিতার একমাত্র পুত্র। একজন ভাই-এর অভাব তাই খুবই অনুভব করতেন তিনি। আর সেই অভাব পূরণ করেছিলেন শঙ্কর, কিন্তু এ সব তো বাইরের ব্যাপার। এগুলো ছাড়াও শঙ্করের মধ্যে এমন গুণ ছিল, যার জন্য পাকা সাহেব সফদর সাদাসিধে শঙ্করের প্রতি এতটা স্নেহপরায়ণ এবং শ্রদ্ধাবান। শঙ্কর ছিলেন অত্যন্ত নম্র প্রকৃতির কিন্তু খোসামোদ করতে জানতেন না। ফলে, প্রথম শ্রেণীতে এম.এ.পাশ করেও আজও তিনি সরকারী স্কুলের। সামান্য শিক্ষকই। তিনি যদি সামান্য একটু ইঙ্গিত করতেন। তবে আপরে তাঁর জন্য সুপারিশ করতে পারত এবং তাতে তিনি কোনো হাইস্কুলের হেডমাস্টার হয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হয়, সারাজীবন সহকারী শিক্ষক হয়েই তিনি থাকতে চান। হ্যাঁ একবার অবশ্য বন্ধুর সাহায্য নিয়ে-ছিলেন-লক্ষীের বাইরে যখন বদলী করা হয়েছিল তাঁকে। বিনয়ের সঙ্গে আত্মসম্মান বোধও শঙ্কর সিংহের মধ্যে ছিল প্রবল, যাক অত্যন্ত সম্ভ্রম করে চলতেন। সফদর সাহেব। তাদের বারো বছর বয়সের বন্ধুত্ব আজ বিশ বছর পরেও ঠিক তেমনি আছে।