৩.
১০ই মে (১৮৫৭ খৃঃ) মঙ্গল সিংহ মীরাটের কাছে ছিল, এই সময় সৈন্যেরা বিদ্রোহের ধ্বজা ওড়াল। বাহাদুর শাহের প্রতিনিধিদের নামে একটা বাহিনীকে সে নিজের অধীনে রাখবার সুযোগ পেল। মঙ্গল সিংহের যোগ্যতা সম্পর্কে কারও কোনো সংশয় ছিল না, কিন্তু তারা জানত যে তার উদ্দেশ্য অন্যান্য নেতৃবর্গ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, তাই তাকে দিল্লীর দিকে না পাঠিয়ে, পূর্বদিকে পাঠিয়ে দিল। তারা কেউ ভাবতে পারেনি, মীরাটের পূর্ব এবং পশ্চিমের ঐ রাস্তা ভারতবর্ষের মুক্তিযুদ্ধের ভাগ্যে কোনো পৃথক ফল প্রসব করবে না। দিল্লীর দিকে ধাবিত সৈন্যদের মঙ্গল সিংহের মতো নেতার প্রয়োজন ছিল-যে দিল্লীর প্রতিষ্ঠাকে পূর্ণভাবে যুদ্ধজয়ের কাজে লাগাতে পারত। মঙ্গল সিংহের বাহিনীতে এক হাজার সৈন্য ছিল। তারা ভাবত আমরা সকলেই জেনারেল। এদের এই কথাটা বোঝাতেই মঙ্গল সিংহের এক সপ্তাহ লেগে গেল যে, শুধু জেনারেলের বাহিনী কখনও যুদ্ধে জিততে পারে না। সৈন্যবাহিনীতে মঙ্গল সিংহ ছাড়া উচ্চ সৈনিক-বিদ্যা সম্বন্ধে ওয়াকিফয়াল দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ছিল না। আর এই একই অবস্থা সমগ্ৰ বিদ্রোহী বাহিনীতে। এক জায়গায় থেকে শিক্ষা দেবার সুযোগ মঙ্গল সিংহের ছিল না। তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, অধিকতর এলাকায় ইংরেজ শাসনকে দ্রুত ধ্বংস করা।
গঙ্গা পার হয়ে রোহেলখণ্ডে প্রবেশ করেই মঙ্গল সিংহ প্রত্যেক রাতে সৈন্যদের কাছে রাজনৈতিক আদর্শের কথা প্রচার করত। সৈন্যদের বুঝতে বেশি সময় লাগত, তাদের মনে নানা রকম সন্দেহ জাগত, মঙ্গল সিংহ সেগুলো দূর করে দিত। এরপর মঙ্গল সিংহ ফ্রান্সেরদুটো বিপ্লবের ইতিহাস (১৭৯২ ও ১৮৪৮ খৃঃ) শোনাল, এও বলল যে, কি করে ওয়েলসের মজুরশ্রেণী ভারত-শাসক এই ইংরেজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, এবং অসীম কৃতিত্বের সঙ্গে লড়েছিল। সংখ্যাবলের সাহায্যে পুঁজিপতিরা তাদের দমন করতে পেরেছিল। কিন্তু তাদের অর্জিত অধিকারকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। এইসব শুনে যুদ্ধরত তার সৈন্যদের আচরণ সম্পূর্ণ বদলে গেল।
এদের প্রত্যেকেই স্বাধীনতা-যুদ্ধের সাধক হয়ে উঠল, তারা গ্রাম-শহরে গিয়ে কথায়। এবং ব্যবহারে লোকের মনে বিশ্বাস এবং সম্মানের উদ্রেক করতে লাগল। ইংরেজদের খাজনার প্রতিটি পয়সা ঠিকমতো ব্যয় করা-প্রয়োজন হলে লোকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা, কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েত কায়েম করে তার কাছ থেকে এবং লোককে বুঝিয়ে তাদের ইচ্ছা এবং ক্ষমতা অনুসারে-এসব কাজ তারা মঙ্গল সিংহের নির্দেশ অনুযায়ী করেছিল। কোনো জিনিসই বিনামূল্যে না নেওয়া এবং প্রত্যেকটি জায়গায় হাজার হাজার লোকের মধ্যে মঙ্গল সিংহের বক্তৃতা এগুলো এমনই ব্যাপার ছিল যার প্রভাবে দলে দলে তরুণীরা স্বাধীনতার সৈন্যদলে ভর্তি হবার জন্য আসতে লাগল।
মঙ্গল সিংহ সৈনিকদের শিক্ষার ব্যাপারে শুধু প্যারেডই নয়—গুপ্তচর, রসদ-সংগ্ৰহ ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষা দিতে লাগল, হাকিম এবং বৈদ্যের এক বাহিনীও সে সঙ্গে রাখল। সামন্তশাহী লুটতরাজ এবং দুনীতির পঙ্ক পরিষ্কার করবার জন্য শিক্ষিতদের মধ্যে দেশভক্তি জাগানো প্রয়োজন ছিল আর এই সময়ে সেটা সহজ কাজ ছিল না। তবুও দুটো দিন মঙ্গল সিংহের সঙ্গে যে থেকে গেছে, সে তার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারেনি। সিপাহীদের মধ্যে মঙ্গল সিংহের আচরণ দেখে কেউ বলতে পারত না যে সেই অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত তার সৈন্য সংখ্যা দু’হাজার অবধি পৌঁছেছিল। তার ইঙ্গিতে প্ৰাণ দেবার জন্য পল্টনের প্রত্যেকটি প্ৰাণ সদা প্রস্তুত থাকত। মঙ্গল সিংহ সব সময়েই সিপাহীদের সঙ্গে একত্রে আহার করত, তাদেরই মতো কম্বলে শয়ন করত, আর বিপদের সময় সকলের আগে রপিয়ে পড়ত। বন্দী ইংরেজ স্ত্রী-পুরুষকে সে যথেষ্ট আরামে রেখেছিল। তারাও সেনাপতির ভদ্র আচরণ দেখে বিস্মিত হত, কারণ ঐ সময়ে ইউরোপেও কয়েদীদের সঙ্গে এই ধরনের ভদ্র ব্যবহার করা হত না। মঙ্গল সিংহ রোহেল্যখণ্ডের চারিটি জেলায় গেল এবং সব জায়গাতেই সুশাসন প্ৰতিষ্ঠা করল।
নানাসাহেব ৫ই জুন (১৮৫৭ খৃঃ) ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করল এবং দেড় মাস যেতে না যেতেই ১৮ই জুলাই ইংরেজদের কাছে তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। হাওয়া ঘুরে গিয়েছে এটা বুঝতে মঙ্গল সিংহের দেরী হল না, তবুও আজাদীর ঝােণ্ডাকে সে জীবিতাবস্থায় ভুলুষ্ঠিত হতে দিল না। ইংরেজদের সৈন্যরা অযোধ্যায় নিরস্ত্র জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করল, স্ত্রীলোকের প্রাণ, মান ইজ্জৎ পায়ের তলায় গুড়িয়ে ফেলল, এ সব শুনেও মঙ্গল সিংহ এবং তার সৈন্যেরা কোনো বন্দী ইংরেজের দেহে হস্তক্ষেপ করল না।
বর্ষাকাল শেষ হতে না হতে সব জায়গাতেই বিদ্রোহীদের হাত থেকে অস্ত্ৰ খসে পড়ল কিন্তু রোহেলখণ্ড এবং পশ্চিম অযোধ্যায় মঙ্গল সিংহ অস্ত্র উঁচিয়ে রাখল। চারিদিক থেকে ইংরেজ, গুর্থ এবং শিখ সৈন্যেরা তার ওপর আক্রমণ চালিয়ে চলেছিল। মুক্তিসেনার সংখ্যা দিনে দিনে কমে যেতে লাগল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেককে বাড়ি পাঠিয়ে দিল মঙ্গল সিংহ, কিন্তু মীরাট থেকে আগত এক হাজার সৈন্যের মধ্যে কেউই তার সঙ্গ ছাড়তে রাজি হল না। অবশেষে মঙ্গল সিংহ এমন এক ব্যাপার দেখল যা তার কাছে মৃত্যুকেও আনন্দময় করে তুলল। উৎসগীকৃত প্ৰাণ, দেশব্রতী তার এই ছোট বাহিনীতে ব্ৰাহ্মণ, রাজপুত, জাঠ, গুর্জর, হিন্দু-মুসলমানের সকল ভেদাভেদ চলে যেতে লাগল। সকলে এক সঙ্গে রুটি বানাতে লাগল এবং এক সঙ্গে খেতে লাগল। এই ভাবে তারা ভারতবর্ষের এক জাতিত্ত্বের উদাহরণ স্থাপন করল।