‘আরও একটি বিষয়ে আমাদের ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। এখন থেকেই জনসাধারণকে বোঝাতে হবে যে, আমরা দেশের মুক্তিযোদ্ধা।’
পূর্বাঞ্চলের এক প্রতিনিধি বলল, ‘আমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করব-এই ব্যাপারটাই কি এ কথা বোঝাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়?’।
মঙ্গল সিংহ, ‘সমস্ত জায়গাতেই তো চব্বিশ ঘণ্টা অস্ত্ৰ ঝনৃঝন করবে না। আমাদের ‘ দেশে বহু কাপুরুষ রয়েছে যারা ইংরেজের অজেয়তা সম্পর্কে বিশ্বাসী। তারা নানা রকমের গুজব রটাবে। আমার মনে হয়, পূর্ব পশ্চিম এবং মধ্য–এই তিন ভাগে ভাগ করে তিনটি হিন্দী এবং উর্দু খবরের কাগজ আমাদের ছাপতে হবে।’
নানাসাহেব, ‘ইংরেজি কায়দা-কানুন আপনার বেশি পছন্দ ঠাকুরুসাহেব। কিন্তু খবরের কাগজ ছাড়াই আমরা কাতুর্জের ব্যাপারটা রটিয়ে কিভাবে জনসাধারণকে তৈরি করেছি তা তো দেখছেন!’
মঙ্গল সিংহ, ‘কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে ইংরেজের চাকরেরা আমাদের বিরুদ্ধে যে সব কথা রটাবে, তার জন্য কিছু একটা করতে হবে নানাসাহেব। একদিনেই তো আমরা ইংরেজের গোটা শাসনযন্ত্রকে অধিকার করে নিতে পারব না। মনে করুন তারা গুজব রটিয়ে দিল যে, বিদ্রোহী সৈন্যরা, মনে রাখবেন আমাদের এই নামেই ডাকবে তারা-গ্রাম এবং শহর লুট করতে, ছোট ছেলেমেয়েদেরকে কেটে ফেলতে আসছে।’
নানাসাহেব, ‘এ কথা কি লোক বিশ্বাস করবে?’
মঙ্গল সিংহ, ‘যে কথা রটানো হবে এবং যে রটনার বিরুদ্ধে অন্য কোনো আওয়াজ উঠবে না। সে কথা লোকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবেই।’
নানাসাহেব, ‘মনে হয়, কার্তুজের ব্যাপারে ধর্মবিদ্রোহী বলে ইংরেজদের এত বদনাম করে দিয়েছি যে ওদের কোনো কথাই কেউ বিশ্বাস করবে না।’ ‘
মঙ্গল সিংহ, ‘আমি কিন্তু একে যথেষ্ট মনে করি না। যাইহোক, আমাদের এই লড়াইকে ইংরেজেরা নিছক বিদ্রোহ বলে প্রচার করবে। কিন্তু দুনিয়ায় আমাদের মিত্র এবং ইংরেজের শত্রু অনেক, তারা আমাদের স্বাধীনতা কামনা করে–বিশেষ করে ইউরোপে এ রকম বহু জাতি আছে। এই জন্য আমাদের এই লড়াইকে সমগ্র ইউরোপীয় জনসাধারণের–বিরুদ্ধে জেহাদ রূপে আমরা দাঁড় করাব না এবং শান্তিপূর্ণ ইংরেজ বালবৃদ্ধ নারীদের ওপর হস্তক্ষেপ করব না। তাতে আমাদের কোনো লাভ হবে না, উল্টে দুনিয়া জুড়ে ভারতবর্ষের বদনাম হবে।
নানাসাহেব, ‘এ সব সেনাপতিদের মনে রাখবার কথা। কোন সময়ে কি করতে হবে, সে সম্বন্ধে তারা নিজেরাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।’
মঙ্গল সিংহ, ‘সবশেষে আমি বলতে চাই, যুদ্ধে যে সৈন্যরা নিজেদের জীবন পণ করছে এবং যে যুদ্ধ জনসাধারণের কাছ থেকেও সাহায্য আশা করছি, তাকে চর্বিযুক্ত কার্তুজের ঝগড়ায় সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। আমাদের বলতে হবে, ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে কি ধরনের রাজত্ব কায়েম করব। সেই রাজত্বে সৈন্য এবং যে কৃষকশ্রেণী থেকে সৈন্যরা আসছে সেই কৃষককুল কি পাবে।’
নানাসাহেব, ‘ধর্মদ্রোহীদের শাসন উঠিয়ে দেওয়াই তো তাদের সন্তুষ্ট করবার জন্য পৰ্যাপ্ত।’
‘এ প্রশ্ন যদি আপনাকেই করা যায় তাহলে কি জবাব দেবেন। আপনি? আপনার মনে কি পেশোয়ার রাজধানী পুণাতে ফিরে যাবার ইচ্ছা নেই? নবাবজাদার অন্তরে কি লক্ষ্মেীর তখতের আকর্ষণ নেই? যখন আপনারা কার্তুজ এবং ইংরেজ-শাসন থেকে মুক্ত হবার চেয়েও বড় ইচ্ছা পোষণ করেন-যার জন্য আপনারা জীবনকে বাজী রাখতে চলেছেন, তখন আমি মনে করি, জনসাধারণের সামনেও ভবিষ্যৎ লাভের বিষয়ে কিছু বলে রাখা উচিত। যেমন, গ্রামে গ্রামে আমরা পঞ্চায়েত বানাব, যাতে সমস্ত গ্রামের প্রজাসাধারণ নির্বাচন করবে এবং বাদশাহের ওপরও যার ক্ষমতা থাকবে। জমিদারী প্রথা আমরা উঠিয়ে দেব এবং কৃষক আর সরকারের মাঝে কোনো স্বত্বভোগী থাকবে না। জায়গীর যারা পাবে তারা শুধু সরকারকে দেয় খাজনাই আদায় করতে পারবে। যাতে কেউ–বেকার বসে না থাকে সে জন্যে সেচকার্যের উপযোগী নালা আর বাঁধ তৈরি করব আমরা। তাতে কোটি-কৌটি মজুরের কাজ মিলবে, দেশের মধ্যে বহুগুণ বেশি তরিতরকারী জন্মাবে এবং কৃষি-কাজের জন্য অনেক নতুন জমি পাওয়া যাবে।’
মঙ্গল সিংহের কথাগুলোকে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইল না। সকলের মতে ওগুলো সব রাজত্ব হাতে আসবার পরের কথা।
খাঁটিয়ার ওপর শোবার অনেকক্ষণ পরেও মঙ্গল সিংহের চোখে ঘুম এল না। সে ভাবছিল, এটা বৈজ্ঞানিক যুগ। রেল, তার, স্টিমারের যাদুকে সে স্বচক্ষে দেখছে। দিয়াশলাই, ফটোগ্রাফি এবং বিদ্যুতের যুগে মানব-সমাজে প্রবেশ করছে; কিন্তু এইসব লোক পুরনো যুগের স্বপ্ন দেখছে। তবুও এই ঘোর অন্ধকারের মাঝে একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পারল সে। এই লড়াই শুধু জনসাধারণের শক্তি দিয়েই পরিচালনা করা সম্ভব হবে, ফলে জনগণ আপন শক্তিকে চিনতে পারবে। বিলাতী পুঁজিপতিরা যেমন বিলাতের মজুরশ্রেণীর সাহায্য নিয়ে আপন প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করে মজুরদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে,–এই ভারতীয় সামন্তরাও ভারতীয় জনতা-সৈন্যবাহিনী ও কৃষককুলের সঙ্গে কাজ শেষ হয়ে গেলেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে। কিন্তু এরা জনসাধারণের মন থেকে তাদের আত্মবিশ্বাসকে। ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বাইরের শত্রুর কাছ থেকে বাঁচাবার জন্যে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে কাজে লাগাবেই। রেল-লাইন, টেলিগ্রাফের লাইন, কলকাতায় প্রস্তুত স্টিমার এখন আর ভারত থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না। মঙ্গল সিংহের আস্থা অবক্ষয়ী সামন্তনায়কদের ওপর ছিল না, ছিল পৃথিবীতে মানব-সমাজের পরিবর্তনকারী শক্তিশালী জনগণের ওপরেই।