বিদ্রোহী নেতাদের সযত্ন-রক্ষিত মনোভাব বুঝতে মঙ্গল সিংহের দেরী লাগল না। সে দেখল যে, পদচ্যুত সামন্তরা নিজ-নিজ অধিকারকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে এবং তার জন্য সকলের সাধারণ শত্রু ইংরেজকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। তাদের কাছে আত্মত্যাগী সৈন্যরা দাবার খুঁটির বেশি আর কিছুই নয়। ধর্ম নষ্ট হবার ভয়ে সিপাহীরা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। কাতুর্জের চর্বি যদি দাঁতে কাটতে না হত তাহলে সম্ভবত অনন্তকাল তারা কোম্পানীর জয়-জয়কার করে যেত, নিজেদের প্রাণও বিসর্জন দিত। আর হিন্দু মুসলমানের গ মধ্যে পার্থক্য-সে তো এতটুকুও কমেনি। উপরন্তু যদি বিদ্রোহ সফল হয়, তবে ধর্মের নামে। গর্বিত নিরক্ষর সিপাহী আল্লা এবং ভগবানের কৃপাপাত্র হবার আশায় নিজেদের আরও বেশি কঠোর ধাৰ্মিক বলে প্রমাণিত করবার চেষ্টা করবে। হয়ত গ্রাম এবং শহরগুলো লুণ্ঠন করতেও চাইবে তারা। যদিও এই ধরনের মনোবৃত্তি-সম্পন্ন সিপাহীদের সংখ্যা কমই ছিল এবং কম জায়গাতেই এমনি লুণ্ঠন চলেছিল। তা’হলেও সোরগোল এতটা বেশি হয়েছিল যে, গ্রামের লোকেরা ডাকাত পড়ার মতো আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়ে উঠেছিল। দেশের মুক্তিদাতা সেনাবাহিনীর প্রতি এমন মনোভাব ভালো নয়। এ-সব জেনে মঙ্গল সিংহ প্রথমটায় নিরাশ হল। চেৎসিংহের সিংহাসন পুনরুদ্ধারের আশায় সে দেশে ফেরেনি, এসেছিল সাম্য-মৈত্রীস্বাধীনতার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাতে জাত-পাত, হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ, ইংরেজ পুঁজিপতিদের শাসনের মতোই অবাঞ্ছনীয়। কূপমণ্ডুক তাকে সংরক্ষিত করতে সে চায়নি, ভারতবর্ষের বহু শতাব্দী-ব্যাপী সঙ্কীর্ণ আবেষ্টনীকে ভেঙে তাকে বিশ্বের অভিন্ন অংশ রূপে প্রতিষ্ঠা করতে সে চেয়েছিল। ইংরেজ পুঁজিপতিদের শাসন এবং শোষণকে হঠিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষের জনসাধারণকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে এক সুন্দর জগৎ নির্মাণে উদ্ধৃদ্ধ করতে চেয়েছিল। কাতুর্জের চর্বির মিথ্যা প্রচারকে সে সমর্থন করতে পারেনি। কারণ এর দ্বারা ভারতবর্ষে ধর্ম আবার তার শিকড় গেড়ে বসবে।
নানাসাহেব এবং অপরাপর নেতারা দামী বিলাতী মদ ওড়াত এবং সুযোগ পেলেই মদ। আর মাংস খেয়ে গৌরাঙ্গী সুন্দরীদের এঁটো ঠোঁট লেহন করবার জন্য লালায়িত হয়ে পড়ত। মজার ব্যাপার হল, এরাই ধৰ্মরক্ষার পবিত্র কর্তব্য নিয়ে বিক্ষুব্ধ সেনাবাহিনীর নেতৃপদ দখল করে বসল। এই সমস্ত দোষ-ত্রুটির সঙ্গে যখন একটা বিষয় মঙ্গল সিংহ চিন্তা করল, তখন আপন কর্তব্য স্থির করে ফেলতে তার দেরী হল না। যুগপৎ ইংরেজ-শাসক এবং ভারতীয় সামন্তদের গোলামীতে পিষ্ট হচ্ছিল ভারতবর্ষ, যার মধ্যে মজবুত এবং সুচতুর শাসন হল ইংরেজের। এদের হঠিয়ে দেবার পর শুধু স্বদেশী সামন্তদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।–ভারতীয় জনসাধারণের পক্ষে যা অধিকতর সহজ কাজ।
জানুয়ারি মাস। রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল, যদিও লণ্ডনের তুলনায় সেটা কিছুই নয়। বিঠরে চারিদিকে স্তব্ধতা বিরাজ করছিল। কিন্তু পেশোয়ার প্রাসাদের প্রহরীরা স্ব-স্ব স্থানে। প্রহরায় নিযুক্ত। নিজেদের প্রভুর এক বিশ্বস্ত অনুচরের সঙ্গে এক অপরিচিত ব্যক্তিকে তারা মহলের ভিতর ঢুকতে দেখল। তারা আজকাল এমনি অপরিচিতদের প্রতি রাত্ৰেই মহলের ভিতরে ঢুকতে দেখে।
নানাসাহেবের সঙ্গে মঙ্গল সিংহের সাক্ষাৎ এই প্ৰথম নয়, কাজেই তারা একে অন্যকে বেশ ভালোভাবেই জানত। এখানে দিল্লীর বৃত্তিভোগী বাদশাহ, অযোধ্যার নবাব, জগদীশপুরের কুঁঅর সিংহ এবং অন্যান্য বহু সামন্তের প্রতিনিধিকে দেখতে পেল মঙ্গল সিংহ। ব্যারাকপুর (কলকাতা), দানাপুর, কানাপুর, লক্ষ্মৌ, আগ্রা, মীরাট প্রভৃতি ক্যান্টনূমেন্টের সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব কতদূর প্রাবল্য লাভ করেছে তা শোনাগেল। এটা আশ্চর্যের কথা যে, এত বড় শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে নেমে নিজেদের একটিও সৈন্য না রেখে এই সব সামন্তরা শুধু বিদ্রোহী সৈন্যদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে বসেছিল। আর যুদ্ধবিদ্যার কথা ধরলে প্রায় সমস্ত নেতারাই ছিল সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবুও নিজেরা সর্বাধিনায়কের পদ অধিকার করবার জন্য ব্যগ্র ছিল। অত্যন্ত আশাপূর্ণ স্বরে নানাসাহেব বলল, ‘ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্ব নির্ভর করছে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ওপর। সেই বাহিনী আজ আমাদের হাতে চলে আসছে।’
‘কিন্তু সমস্ত ভারতীয় সৈন্যই কি আমাদের দিকে আসছে নানাসাহেব? পাঞ্জাবী শিখদের বিদ্রোহ করার কোনো খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অপর পক্ষে অপরাপর ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ইংরেজের পক্ষে লড়াই করে যেভাবে তাদের পাঞ্জাবকে পরাজিত করেছিল সে কথা স্মরণ করে পাঞ্জাবীরা তার প্রতিশোধই নিতে চাইবে। ইংরেজরাও বড় হাঁশিয়ার নানাসাহেব। না হলে পেশোয়া এবং অযোধ্যার নবাবের মতো দিলীপ সিংহকে যদি তারা কোথাও নজরবন্দী করে রাখত, তবে আজ সমস্ত শিখ পল্টনকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা খুবই সহজ হত। যাহোক, আমাদের মনে রাখতে হবে, শিখ এবং নেপালী দেশীয় রাজ্যসমূহের পল্টনেরা আমাদের দিকে নেই। আর দেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আমাদের সঙ্গে নেই, তাদের বিরোধী বলেই ধরতে হবে।’
নানাসাহেব বলল, ‘আপনার কথা ঠিকই ঠাকুরাসাহেব। কিন্তু যদি সূচনাতেই আমরা সাফল্য লাভ করতে পারি, তবে কোনো দেশদ্রোহীরই আমাদের বিরুদ্ধে লড়বার সাহস হবে না।’