৫
নাসিরুদ্দীন মাহমুদ
গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহের পরাজয় ও পতনের ফলে লখনৌতি রাজ্য সম্পূর্ণভাবে দিল্লির সুলতানের অধীনে আসিল। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস প্রথমে নাসিরুদ্দীন মাহমুদকেই লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। নাসিরুদ্দীন মাহমুদ সুলতান গারি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি লখনৌতি অধিকার করার পর দিল্লি ও অন্যান্য বিশিষ্ট নগরের আলিম, সৈয়দ এবং অন্যান্য ধার্মিক ব্যক্তিদের কাছে বহু অর্থ পাঠাইয়াছিলেন। নাসিরুদ্দীন অত্যন্ত যোগ্য ও নানাগুণে ভূষিত ছিলেন। তাঁহার পিতা ইলতুৎমিসের নিকট একবার বাগদাদের খলিফার নিকট হইতে খিলাৎ আসিয়াছিল, ইলতুৎমিস তাঁহার মধ্য হইতে একটি খিলাৎ ও একটি লাল চন্দ্রাতপ লখনৌতিতে পুত্রের কাছে পাঠাইয়া দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাত্র দেড় বৎসর লখনৌতি শাসন করিবার পরেই নাসিরুদ্দীন মাহমুদ রোগাক্রান্ত হইয়া পরলোকগমন করেন। তাঁহার মৃতদেহ লখনৌতি হইতে দিল্লিতে লইয়া গিয়া সমাধিস্থ করা হয়।
নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পিতার অধীনস্থ শাসনকর্ত্তা হিসাবে লখনৌতি শাসন করিলেও পিতার অনুমোদনক্রমে নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন। তাঁহার কোন কোন মুদ্রায় বাগদাদের খলিফার নাম দেখিতে পাওয়া যায়।
৬
ইখতিয়ারুদ্দীন মালিক বলকা
নাসিরুদ্দীন মাহমুদের শাসনকালে হসামুদ্দীন ইউয়জের পুত্র ইখতিয়ারুদ্দীন দৌলৎ শাহ-ই-বলকা আমীরের পদ লাভ করিয়াছিলেন। নাসিরুদ্দীনের মৃত্যুর পর তিনি বিদ্রোহী হইলেন এবং লখনৌতি রাজ্য অধিকার করিলেন। তখন ইলতুৎমিস তাঁহাকে দমন করিতে সসৈন্যে লখনৌতি আসিলেন এবং তাঁহাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া আলাউদ্দীন জানী নামে তুর্কীস্থানের রাজবংশসম্ভুত এক ব্যক্তিকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিয়া দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
৭
আলাউদ্দীন জানী, সৈফুদ্দীন আইবক য়গানতৎ ও আওর খান
আলাউদ্দীন জানী অল্পদিন লখনৌতি শাসন করিবার পরে ইলতুৎমিস কর্ত্তৃক পদচ্যুত হন এবং সৈফুদ্দীন আইবক নামে আর এক ব্যক্তি তাঁহার স্থানে নিযুক্ত হন। সৈফুদ্দীন আইবক অনেকগুলি হাতি ধরিয়া ইলতুৎমিসকে পাঠাইয়াছিলেন, এজন্য ইলতুৎমিস তাঁহাকে ‘য়গানতৎ’ উপাধি দিয়াছিলেন। দুই-তিন বৎসর শাসনকর্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর সৈফুদ্দীন আইবক য়গানতৎ পরলোকগমন করেন। প্রায় একই সময়ে দিল্লিতে ইলতুৎমিসও পরলোকগমন করিলেন (১২৩৬ খ্রী)।
ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরে তাঁহার উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ লইয়া প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তারা স্বাধীন রাজার মতো আচরণ করিতে লাগিলেন। এই সময়ে আওর খান নামে একজন তুর্কী লখনৌতি ও লখনোর অধিকার করিয়া বসিলেন। বিহারের শাসনকর্ত্তা তুগরল তুগার খানের সহিত তাঁহার বিবাদ বাধিল এবং তুগান খান লখনৌতি আক্রমণ করিলেন। লখনৌতি নগর ও বসনকোট দুর্গের মধ্যবর্তী স্থানে তুগান খান আওর খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাকে পরাজিত ও নিহত করিলেন। ফলে লখনোর হইতে বসনকোট পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন তুগান খানের হস্তে আসিল।
৮
তুগরল তুগান খান
তুগান খানের শাসনকালে সুলতানা রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার অভিষেকের সময়ে তুগান খান দিল্লিতে কয়েকজন প্রতিনিধি পাঠাইয়াছিলেন। রাজিয়া তুগান খানকে একটি ধ্বজ ও কয়েকটি চন্দ্রাতপ উপহার দিয়াছিলেন। তুগাল খান সুলতানা রাজিয়ার নামে লখনৌতির টাকশালে মুদ্রাও উত্তীর্ণ করাইয়াছিলেন। রাজিয়ার সিংহাসনচ্যুতির পরে তুগান খান অযোধ্যা, কড়া ও মানিকপুর প্রভৃতি অঞ্চল অধিকার করিয়া বসিলেন।
এই সময়ে ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’র লেখক মীনহাজ-ই-সিরাজ অযোধ্যায় ছিলেন। তুগরল তুগান খানের সহিত মীনহাজের পরিচয় হইয়াছিল। তুগান খান মীনহাজকে বাংলাদেশে লইয়া আসেন। মীনহাজ প্রায় তিন বৎসর এদেশে ছিলেন এবং এই সময়কার ঘটনাবলী তিনি স্বচক্ষে দেখিয়া তাঁহার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।
তুগান খানের শাসনকালে জাজনগরের (উড়িষ্যা) রাজা লখনৌতি আক্রমণ করেন। উড়িষ্যার শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে জানা যায় যে, এই জাজনগররাজ উড়িষ্যার গঙ্গবংশীয় রাজা প্রথম নরসিংহদেব। তুগরল তুগান খান তাঁহার আক্রমণ প্রতিহত করিয়া পাল্টা আক্রমণ চালান এবং জাজনগর অভিমুখে অভিযান করেন (৬৪১ হি = ১২৪৩-৪৪ খ্রী)। মীনহাজ-ই-সিরাজ এই অভিযানে তুগান খানের সহিত গিয়াছিলেন। তুগান খান জাজনগর রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত কটাসিন দুর্গ অধিকার করিয়া লইলেন। কিন্তু দুর্গ জয়ের পর যখন তাঁহার সৈন্যরা বিশ্রাম ও আহারাদি করিতেছিল, তখন জাজনগররাজের সৈন্যরা অকস্মাৎ পিছন হইতে তাহাদের আক্রমণ করিল। ফলে তুগান খান পরাজিত হইয়া লখনৌতিতে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হইলেন। ইহার পর তিনি তাঁহার দুইজন মন্ত্রী শফুলমুল আশারী ও কাজী জলালুদ্দীন কাসানীকে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দীন মসূদ শাহের কাছে পাঠাইয়া তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। আলাউদ্দীন তখন অযোধ্যার শানকর্ত্তা কমরুদ্দীন তমুর খান-ই-কিরানকে তুগান খানের সহায়তা করিবার আদেশ দিলেন। ইতিমধ্যে জাজনগরের রাজা আবার বাংলা দেশ আক্রমণ করিলেন। তিনি প্রথমে লখনোর আক্রমণ করিলেন এবং সেখানকার শাসনকর্ত্তা ফখু-উ-মুল করিমুদ্দীন লাগরিকে পরাজিত ও নিহত করিয়া স্থান দখল করিয়া লইলেন। তাঁহার পর তিনি লখনৌতি অবরোধ করিলেন। অবরোধের ফলে তুগান খানের খুবই অসুবিধা হইয়াছিল, কিন্তু অবরোধের দ্বিতীয় দিনে অযোধ্যার শাসনকর্ত্তা তমুর খান তাঁহার সৈন্যবাহিনী লইয়া উপস্থিত হইলেন। তখন জাজনগররাজ লখনৌতি পরিত্যাগ করিয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিলেন।