২
ইজুদ্দীন মুহম্মদ শিরান খিলজী
ইজুদ্দীন মুহম্মদ শিরান খিলজী ও তাঁহার ভ্রাতা আহমদ শিরান বখতিয়ার খিলজীর অনুচর ছিলেন। বখতিয়ার তিব্বত অভিযানে যাত্রা করিবার পূর্বে এই দুই ভ্রাতাকে লখনোর ও জাজনগর আক্রমণ করিতে পাঠাইয়াছিলেন। তিব্বত হইতে বখতিয়ারের প্রত্যাবর্তনের সময় মুহম্মদ শিরান জাজনগরে ছিলেন। বখতিয়ারের তিব্বত অভিযানের ব্যর্থতার কথা শুনিয়া তিনি দেবকোটে প্রত্যাবর্তন করিলেন। ইতিমধ্যে বখতিয়ার পরলোকগমন করিয়াছিলেন। তখন মুহম্মদ শিরান প্রথমে নারান-কোই আক্ৰমণ করিয়া আলী মর্দানকে পরাস্ত ও বন্দী করিলেন এবং দেবকোটে ফিরিয়া আসিয়া নিজেকে বখতিয়ারের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করিলেন। এদিকে আলী মর্দান কারাগার হইতে পলায়ন করিয়া দিল্লিতে সুলতান কুত্ৰুদ্দীন আইবকের শরণাপন্ন হইলেন। কায়েমাজ রুমী নামে কুত্ৰুদ্দীনের জনৈক সেনাপতি এই সময়ে অযোধ্যায় ছিলেন, তাঁহাকে কুত্ৰুদ্দীন লখনৌতি আক্রমণ করিতে বলিলেন। কায়েমাজ লখনৌতি রাজ্যে পৌঁছিয়া অনেক খিলজী আমীরকে হাত করিয়া ফেলিলেন। বখতিয়ারের বিশিষ্ট অনুচর, গাঙ্গুরীর জায়গীরদার হসামুদ্দীন ইউয়জ অগ্রসর হইয়া কায়েমাজকে স্বাগত জানাইলেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া দেবকোটে লইয়া গেলেন। মুহম্মদ শিরান তখন কায়েমাজের সহিত যুদ্ধ না করিয়া দেবকোট হইতে পলাইয়া গেলেন। অতঃপর কায়েমাজ হসামুদ্দীনকে দেবকোটের কর্তৃত্ব দান করিলেন। কিন্তু কায়েমাজ অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করিলে মুহম্মদ শিরান এবং তাঁহার দলভুক্ত খিলজী আমীররা দেবকোট আক্রমণের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
এই সংবাদ পাইয়া কায়েমাজ আবার ফিরিয়া আসিলেন। তখন তাঁহার সহিত মুহম্মদ শিরান ও তাঁহার অনুচরদের যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে মুহম্মদ শিরান ও তাঁহার দলের লোকেরা পরাজিত হইয়া মদা এবং সন্তোষের দিকে পলায়ন করিলেন। পলায়নের সময় তাঁহাদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ হইল এবং এই বিবাদের ফলে মুহম্মদ শিরান নিহত হইলেন।
৩
আলী মর্দান (আলাউদ্দীন)
আলী মর্দান কিছুকাল দিল্লিতেই রহিলেন। কুলুদ্দীন আইবক যখন গজনীতে যুদ্ধ করিতে গেলেন, তখন তিনি আলী মর্দানকে সঙ্গে লইয়া গেলেন। গজনীতে আলী মর্দান তুর্কীদের হাতে বন্দী হইলেন। কিছুদিন বন্দীদশায় থাকিবার পর আলী মর্দান মুক্তিলাভ করিয়া দিল্লিতে ফিরিয়া আসিলেন। তখন কুস্তুদ্দীন তাঁহাকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। আলী মর্দান দেবকোটে আসিলে হসামুদ্দীন ইউয়জ তাহাকে অভ্যর্থনা জানাইলেন এবং আলী মর্দান নির্বিবাদে লখনৌতির শাসনভার গ্রহণ করিলেন। (আ ১২১০ খ্রী)।
কুলুদ্দীন যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন আলী মর্দান দিল্লির অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন। কিন্তু কুল্লুদ্দীন পরলোকগমন করিলে (নভেম্বর ১২১০ খ্রী) আলী মর্দান স্বাধীনতা ঘোষণা করিলেন এবং আলাউদ্দীন নাম লইয়া সুলতান হইলেন। তাঁহার পর তিনি চারিদিকে সৈন্য পাঠাইয়া বহু খিলজী আমীরকে বধ করিলেন। তাঁহার অত্যাচার ক্রমে ক্রমে চরমে উঠিল। তিনি বহু লোককে বধ করিলেন এবং নিরীহ দরিদ্র লোকদের দুর্দশার একশেষ করিলেন। অবশেষে তাঁহার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া বহু খিলজী আমীর ষড়যন্ত্র করিয়া আলী মর্দানকে হত্যা করিলেন। ইহার পর তাঁহারা হসামুদ্দীন ইউয়জকে লখনৌতির সুলতান নির্বাচিত করিলেন। হসামুদ্দীন ইউয়জ গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে বসিলেন (আ ১২১৩ খ্রী)।
৪
গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ
গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ ১৪ বৎসর রাজত্ব করেন। তিনি প্রিয়দর্শন, দয়ালু ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন। আলিম, ফকির ও সৈয়দদের তিনি বৃত্তি দান করিতেন। দূরদেশ হইতেও বহু মুসলমান অর্থের প্রত্যাশী হইয়া তাঁহার কাছে আসিত এবং সন্তুষ্ট হইয়া ফিরিয়া যাইত। বহু মসজিদও তিনি নির্মাণ করাইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দীনের শাসনকালে দেবকোটের প্রাধান্য হ্রাস পায় এবং লখনৌতি পুরাপুরি রাজধানী হইয়া উঠে। গিয়াসুদ্দীনের আর একটি বিশেষ কীর্তি দেবকোট হইতে লখনোর বা রাজনগর (বর্তমান বীরভূম জেলার অন্তর্গত) পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ উচ্চ রাজপথ নির্মাণ করা। এই রাজপথটির কিছু চিহ্ন পঞ্চাশ বছর আগেও বর্তমান ছিল। গিয়াসুদ্দীন বসকোট বা বসনকোট নামক স্থানে একটি দুর্গও নির্মাণ করাইয়াছিলেন। বাগদাদের খলিফা অন্নাসিরোলেদীন ইল্লাহের নিকট হইতে গিয়াসুদ্দীন তাঁহার রাজ-মর্যাদা স্বীকারসূচক পত্র আনান। গিয়াসুদ্দীনের অনেকগুলি মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। তাহাদের কয়েকটিতে খলিফার নাম আছে।
কিন্তু ১৫ বৎসর রাজত্ব করিবার পর গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহের অদৃষ্টে দুর্দিন ঘনাইয়া আসিল। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ৬২২ হিজরায় (১২২৫-২৬ খ্র) গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহকে দমন করিয়া লখনৌতির দিকে রওনা হইলে গিয়াসুদ্দীন তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য এক নৌবাহিনী পাঠাইলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ইলতুৎমিসের নামে মুদ্রা উৎকীর্ণ করিতে ও খুৎবা পাঠ করিতে স্বীকৃত হইয়া এবং অনেক টাকা ও হাতি উপঢৌকন দিয়া ইলতুৎমিসের সহিত সন্ধি করিলেন। ইলতুৎমিস তখন ইজুদ্দীন জানী নামে এক ব্যক্তিকে বিহারের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া দিল্লিতে ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের প্রত্যাবর্তনের অল্পকাল পরেই গিয়াসুদ্দীন ইজুদ্দীন জানীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া বিহার অধিকার করিলেন। ইজুদ্দীন তখন ইলতুৎমিসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদের কাছে গিয়া সমস্ত কথা জানাইলেন এবং তাঁহার অনুরোধে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ লখনৌতি আক্রমণ করিলেন। এই সময়ে গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ পূর্ববঙ্গ এবং কামরূপ জয় করিবার জন্য যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, সুতরাং নাসিরুদ্দীন অনায়াসেই লখনৌতি অধিকার করিলেন। গিয়াসুদ্দীন এই সংবাদ পাইয়া ফিরিয়া আসিলেন এবং নাসিরুদ্দীনের সহিত যুদ্ধ করিলেন। কিন্তু যুদ্ধে তাঁহার পরাজয় হইল এবং তিনি সমস্ত খিলজী আমীরের সহিত বন্দী হইলেন। অতঃপর গিয়াসুদ্দীনের প্রাণবধ করা হইল (৬২৪ হি = ১২২৬-২৭ খ্রী)।