বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় হইতে সুরু করিয়া তাজুদ্দীন অর্সলানের হাতে ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকীর পরাজয় ও পতন পর্যন্ত লখনৌতি রাজ্যের ইতিহাস একমাত্র মীনহাজ-ই-সিরাজের ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ হইতে জানা যায়। নীচে এই গ্রন্থ অবলম্বনে এই সময়কার ইতিহাসের সংক্ষিপ্তসার লিপিবদ্ধ হইল।
নদীয়া ও লখনৌতি বিজয়ের পরে প্রায় দুই বৎসর বখতিয়ার আর কোন অভিযানে বাহির হন নাই। এই সময়ে তিনি পরিপূর্ণভাবে অধিকৃত অঞ্চলের শাসনে মনোনিবেশ করেন। সমগ্র অঞ্চলটিকে তিনি কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত করিলেন এবং তাঁহার সহযোগী বিভিন্ন সেনানায়ককে তিনি বিভিন্ন বিভাগের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। ইহারা সকলেই ছিলেন হয় তুর্কী নাহয় খিলজী জাতীয়। রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে বখতিয়ার আলী মর্দান, মুহম্মদ শিরান, হসামুদ্দীন ইউয়জ প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। বখতিয়ার তাঁহার রাজ্যে অনেকগুলি মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করিলেন। হিন্দুদের বহু মন্দির তিনি ভাঙিয়া ফেলিলেন এবং বহু হিন্দুকে ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করিলেন।
লখনৌতি জয়ের প্রায় দুই বৎসর পরে বখতিয়ার তিব্বত জয়ের সংকল্প করিয়া অভিযানে বাহির হইলেন। লখনৌতি ও হিমালয়ের মধ্যবর্তী প্রদেশে কোচ, মেচ ও থারু নামে তিনটি জাতির লোক বাস করিত। মেচ জাতির একজন সর্দার একবার বখতিয়ারের হাতে পড়িয়াছিল, বখতিয়ার তাহাকে ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করিয়া আলী নাম রাখিয়াছিলেন। এই আলী বখতিয়ারের পথপ্রদর্শক হইল। বখতিয়ার দশ সহস্র সৈন্য লইয়া তিব্বত অভিমুখে যাত্রা করিলেন। আলী মেচ তাঁহাকে কামরূপ রাজ্যের অভ্যন্তরে বেগমতী নদীর তীরে বর্ধন নামে একটি নগরে আনিয়া হাজির করিল। বেগমতী ও বর্ধনের অবস্থান সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। বখতিয়ার বেগমতীর তীরে তীরে দশ দিন গিয়া একটি পাথরের সেতু দেখিতে পাইলেন, তাহাতে বারোটি খিলান ছিল। একজন তুর্কী ও একজন খিলজী আমীরকে সেতু পাহারা দিবার জন্য রাখিয়া বখতিয়ার অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া সেতু পার হইলেন।
এদিকে কামরূপের রাজা বখতিয়ারকে দূতমুখে জানাইলেন যে ঐ সময় তিব্বত আক্রমণের উপযুক্ত নয়; পরের বৎসর যদি বখতিয়ার তিব্বত আক্রমণ করেন, তাহা হইলে তিনিও তাঁহার সৈন্যবাহিনী লইয়া এ অভিযানে যোগ দিবেন। বখতিয়ার কামরূপরাজের কথায় কর্ণপাত না করিয়া তিব্বতের দিকে অগ্রসর হইলেন। পূর্ব্বোক্ত সেতুটি পার হইবার পর বখতিয়ার পনেরো দিন পার্ব্বত্য পথে চলিয়া ষোড়শ দিবসে এক উপত্যকায় পৌঁছিলেন এবং সেখানে লুণ্ঠন সুরু করিলেন; এই স্থানে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। এই দুর্গ ও তাঁহার আশপাশ হইতে অনেক সৈন্য বাহির হইয়া বখতিয়ারের সৈন্যদলকে আক্রমণ করিল। ইহাদের কয়েকজন বখতিয়ারের বাহিনীর হাতে বন্দী হইল। তাহাদের কাছে বখতিয়ার জানিতে পারিলেন যে ঐ স্থান হইতে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে করমপত্তন বা করারপত্তন নামে একটি স্থানে পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য আছে। ইহা শুনিয়া বখতিয়ার আর অগ্রসর হইতে সাহস করিলেন না।
কিন্তু প্রত্যাবর্তন করাও তাঁহার পক্ষে সহজ হইল না। তাঁহার শত্রুপক্ষ ঐ এলাকার সমস্ত লোকজন সরাইয়া যাবতীয় খাদ্যশস্য নষ্ট করিয়া দিয়াছিল। বখতিয়ারের সৈন্যরা তখন নিজেদের ঘোড়াগুলির মাংস খাইতে লাগিল। এইভাবে অশেষ কষ্ট সহ্য করিয়া বখতিয়ার কোনরকমে কামরূপে পৌঁছিলেন।
কিন্তু কামরূপে পৌঁছিয়া বখতিয়ার দেখিলেন পূর্ব্বোক্ত সেতুটির দুইটি খিলান ভাঙা; যে দুইজন আমীরকে তিনি সেতু পাহারা দিতে রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহারা বিবাদ করিয়া ঐ স্থান ছাড়িয়া গিয়াছিল, ইত্যবসরে কামরূপের লোকেরা আসিয়া এই দুইটি খিলান ভাঙিয়া দেয়। বখতিয়ার তখন নদীর তীরে তাঁবু ফেলিয়া নদী পার হইবার জন্য নৌকা ও ভেলা নির্মাণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু সে চেষ্টা সফল হইল না। তখন বখতিয়ার নিকটবর্তী একটি দেবমন্দিরে সসৈন্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু কামরূপের রাজা এই সময় বখতিয়ারের স্বপক্ষ হইতে বিপক্ষে চলিয়া গেলেন। (বোধহয় মুসলমানরা দেবমন্দিরে প্রবেশ করায় তিনি ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন।) তাঁহার সেনারা আসিয়া ঐ দেবমন্দির ঘিরিয়া ফেলিল এবং মন্দিরটির চারিদিকে বাঁশ দিয়া প্রাচীর খাড়া করিল। বখতিয়ারের সৈন্যরা চারিদিকে বন্ধ দেখিয়া মরিয়া হইয়া প্রাচীরের একদিকে ভাঙিয়া ফেলিল এবং তাহাদের মধ্যে দুই-একজন অশ্বারোহী অশ্ব লইয়া নদীর ভিতরে কিছুদূর গমন করিল। তীরের লোকেরা “রাস্তা মিলিয়াছে” বলিয়া চীৎকার করায় বখতিয়ারের সমস্ত সৈন্য জলে নামিল। কিন্তু সামনে গভীর জল ছিল, তাহাতে বখতিয়ার এবং অল্প কয়েকজন অশ্বারোহী ব্যতীত আর সকলেই ডুবিয়া মরিল। বখতিয়ার হতাবশিষ্ট অশ্বারোহীদের লইয়া কোনক্রমে নদীর ওপারে পৌঁছিয়া আলী মেচের আত্মীয়স্বজনকে প্রতীক্ষারত দেখিতে পাইলেন। তাহাদের সাহায্যে তিনি অতিকষ্টে দেবকোটে পৌঁছিলেন।
দেবকোটে পৌঁছিয়া বখতিয়ার সাংঘাতিক রকম অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। ইহার অল্পদিন পরেই তিনি পরলোকগমন করিলেন। (৬০২ হি. = ১২০৫-০৬ খ্র.)। কেহ কেহ বলেন যে বখতিয়ারের অনুচর নারান-কোই-র শাসনকর্ত্তা আলী মর্দান তাঁহাকে হত্যা করেন। তিব্বত অভিযানের মতো অসম্ভব কাজে হাত না দিলে হয়তো এত শীঘ্ন বখতিয়ারের এরূপ পরিণতি হইত না।