বর্তমান পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রনায়কগণ ইতিহস ও ভূগোলকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হইয়া তাহাদের দেশের “বাংলাদেশ’ নাম গ্রহণ করিয়াছেন। ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইহার কোন প্রতিবাদ করেন নাই–ইহার কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক। সাধারণ লোকে কিন্তু বাংলাদেশ” নামের অর্থ পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারে নাই। তাঁহার প্রমাণ–এখনও পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা দৈনন্দিন কথাবার্তায় ও লেখায় পশ্চিমবঙ্গকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করে; ভারতের আন্তঃরাজ্য ক্রীড়া-প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী পশ্চিমবঙ্গের দলগুলি “বাংলা দল” নামে আখ্যাত হয় এবং পশ্চিমবঙ্গে হরতাল পালিত হইলে তাহাকে “বাংলা বন্ধ” বলা হয়। আমরাও “বাংলাদেশ” নামের মৌলিক অর্থকে উৎখাত করার বিরোধী। সেইজন্য বর্তমান গ্রন্থের “বাংলা দেশের ইতিহাস” নাম অপরিবর্তিত রাখা হইল। শুধু পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিবঙ্গ নহে–ত্রিপুরা এবং বর্তমান বিহার ও আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বাংলা-ভাষী অঞ্চলগুলিকেও আমরা “বাংলাদেশ”-এর অন্তর্গত বলিয়া গণ্য করিয়াছি এবং এই সমস্ত অঞ্চলেরই ইতিহাস এই গ্রন্থে আলোচিত হইয়াছে।
শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৩০ শে ভাদ্র, ১৩৮০
৪ নং বিপিন পাল রোড,
কলিকাতা-২৬
০১. বাংলায় মুসলিম অধিকারের প্রতিষ্ঠা
প্রথম পরিচ্ছেদ – বাংলায় মুসলিম অধিকারের প্রতিষ্ঠা
১
ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী
১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তরাওরীর দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হইয়া মুহম্মদ ঘোরী সর্বপ্রথম ভারতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার মাত্র কয়েক বৎসর পরে তুর্কির অধিবাসী অসমসাহসী ভাগ্যান্বেষী ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী অতর্কিতভাবে পূর্ব ভারতে অভিযান চালাইয়া প্রথমে দক্ষিণ বিহার এবং পরে পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গের অনেকাংশ জয় করিয়া এই অঞ্চলে প্রথম মুসলিম অধিকার স্থাপন করিলেন। বখতিয়ার প্রথমে “নোদীয়হ” অর্থাৎ নদীয়া (নবদ্বীপ) এবং পরে “লখনৌতি” অর্থাৎ লক্ষ্মণাবতী বা গৌড় জয় করেন। মীনহাজ-ই-সিরাজের ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে বখতিয়ারের নবদ্বীপ জয়ের বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। বর্তমান গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ঐ বিবরণের সংক্ষিপ্তসার দেওয়া হইয়াছে এবং তাঁহার যাথার্থ্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে।
বখতিয়ারের নবদ্বীপ বিজয় তথা বাংলাদেশে প্রথম মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা কোন্ বৎসরে হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। মীনহাজ-ই সিরাজ লিখিয়াছেন যে বিহার দুর্গ অর্থাৎ ওদন্তপুরী বিহার ধ্বংস করার অব্যবহিত পরে বখতিয়ার বদায়ুনে গিয়া কুলুদ্দীন আইবকের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁহাকে নানা উপঢৌকন দিয়া প্রতিদানে তাঁহার নিকট হইতে খিলাৎ লাভ করেন; কুলুদ্দীনের কাছ হইতে ফিরিয়া বখতিয়ার আবার বিহার অভিমুখে অভিযান করেন এবং ইহার পরের বৎসর তিনি “নোদীয়” আক্রমণ করিয়া জয় করেন। কুলুদ্দীনের সভাসদ হাসান নিজামীর ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে কুস্তুদ্দীন কালিঞ্জর দুর্গ জয় করেন, এবং কালিঞ্জর হইতে তিনি সরাসরি বায়ুনে চলিয়া আসেন; তাঁহার বদায়ুনে আগমনের পরেই “ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার উদ-বিহার (অর্থাৎ ওদন্তপুরী বিহার) হইতে তাঁহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে কুড়িটি হাতি, নানারকমের রত্ন ও বহু অর্থ উপঢৌকনস্বরূপ দিলেন। সুতরাং বখতিয়ার ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দের পরের বৎসর অর্থাৎ ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে নবদ্বীপ জয় করিয়াছিলেন এইরূপ ধারণা করাই সংগত।
“নোদীয়হ” জয়ের পরে, মীনহাজ-ই-সিরাজের মতে, “নোদীয়হ্” ও “লখনৌতি” জয়ের পরে বখতিয়ার লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু বখতিয়ারের জীবদ্দশায় এবং তাঁহার মৃত্যুর প্রায় কুড়ি বৎসর পর পর্যন্ত বর্তমান দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত দেবকোট (আধুনিক নাম গঙ্গারামপুর) বাংলার মুসলিম শক্তির প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল।
নদীয়া ও লখনৌতি জয়ের পরে বখতিয়ার একটি রাজ্যের কার্যত স্বাধীন অধীশ্বর হইলেন। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে বখতিয়ার বাংলা দেশের অধিকাংশই জয় করিতে পারেন নাই। তাঁহার নদীয়া ও লক্ষণাবতী বিজয়ের পরেও পূর্ববঙ্গে লক্ষণসেনের অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল, লক্ষণসেন যে ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দেও জীবিত ও সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁহার প্রমাণ আছে। লক্ষণসেনের মৃত্যুর পরে তাঁহার বংশধররা এবং দেব বংশের রাজারা পূর্ববঙ্গ শাসন করিয়াছিলেন। ১২৬০ খ্রীষ্টাব্দে মীনহাজ-ই-সিরাজ তাঁহার ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থ সম্পূর্ণ করেন। তিনি লিখিয়াছেন যে তখনও পর্যন্ত লক্ষণসেনের বংশধররা পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করিতেছিলেন। ১২৮৯ খ্রীষ্টাব্দেও মধুসেন নামে একজন রাজার রাজত্ব করার প্রমাণ পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দশকের আগে মুসলমানরা পূর্ববঙ্গের কোন অঞ্চল জয় করিতে পারেন নাই। দক্ষিণবঙ্গের কোন অঞ্চলও মুসলমানদের দ্বারা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিজিত হয় নাই। সুতরাং বখতিয়ারকে বঙ্গবিজেতা’ বলা সংগত হয় না। তিনি পশ্চিমবঙ্গে ও উত্তরবঙ্গের কতকাংশ জয় করিয়া বাংলা দেশে মুসলিম শাসনের প্রথম সূচনা করিয়াছিলেন, ইহাই তাঁহার কীর্তি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুসলিম ঐতিহাসিকরাও বখতিয়ারকে ‘বঙ্গবিজেতা’ বলেন নাই; তাহারা বখতিয়ার ও তাঁহার উত্তরাধিকারীদের অধিকৃত অঞ্চলকে লখনৌতি রাজ্য বলিয়াছেন, ‘বাংলা রাজ্য’ বলেন নাই।