মধ্যযুগের ইতিহাসের আকরগ্রন্থগুলিতে সাধারণত হিজরী অব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। পাঠকগণের সুবিধার জন্য এই অব্দগুলির সমকালীন খ্রীষ্টীয় অব্দের তারিখসমূহ পরিশিষ্টে দেওয়া হইয়াছে।
মধ্যযুগে বাংলা দেশে মুসলমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরেও বহুকাল পর্যন্ত কয়েকটি স্বাধীন হিন্দুরাজ্য প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে ত্রিপুরা এবং কোমতা-কোচবিহার এই দুই রাজ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক কালে এ দুয়েরই আয়তন বেশ বিস্তৃত ছিল। উভয় রাজ্যেই শাসন কার্যে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হইত এবং বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হইয়াছিল–হিন্দু ধর্ম্মের প্রাধান্যও অব্যাহত ছিল। ত্রিপুরার রাজকীয় মুদ্রায় বাংলা অক্ষরে রাজা ও রাণী এবং তাঁহাদের ইষ্ট দেবতার নাম লিখিত হইত। মধ্যযুগে হিন্দুর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতীক স্বরূপ বাংলার ইতিহাসে এই দুই রাজ্যের বিশিষ্ট স্থান আছে। এই জন্য পরিশিষ্টে এই দুই রাজ্য সম্বন্ধে পৃথকভাবে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিয়াছি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী কোচবিহারের ও ত্রিপুরার মুদ্রার বিবরণী ও চিত্র সংযোজন করিয়াছেন, এজন্য আমি তাঁহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।
শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৪নং বিপিন পাল রোড
কলিকাতা-২৬
.
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
এই সংস্করণে নবাবিষ্কৃত ত্রিপুরার কয়েকটি মুদ্রার বিবরণ সংযোজিত হইয়াছে। ত্রিপুরা সরকার একখানি নূতন পুঁথি হইতে ‘রাজমালার নূতন সংস্করণ প্রকাশিত করিয়াছেন। এই গ্রন্থখানি কলিকাতায় না পাওয়ায় ত্রিপুরা সরকারের নিকট ভি. পি. ডাকযোগে পাঠাইতে চিঠি লিখিয়াছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় গ্রন্থখানি তো দূরের কথা চিঠির উত্তরও পাই নাই। গ্রন্থখানি যথাসময়ে পাইলে ত্রিপুরা সম্বন্ধে হয়ত নূতন সংবাদ মিলিত। নিজের দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে এরূপ ঔদাসীন্য দুঃখের বিষয়।
ত্রিপুরার কয়েকটি নূতন মুদ্রার সাহায্যে ড. অমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী পরিশিষ্টে ত্রিপুরারাজ্যের মুদ্রা সম্বন্ধে যে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন তাহা পূর্বে কোথাও প্রকাশিত হয় নাই।
বর্তমান রাজনীতিক পরিস্থিতিতে এই গ্রন্থের নামকরণ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। ১৯৪৫ সালে এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইহাতে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ–উভয়েরই ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। তখন হইতেই ইহার নাম “বাংলা দেশের ইতিহাস”। কিছু দিন পূর্ব পর্যন্ত এই নামের অর্থ তথা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে কাহারও মনে কোন সন্দেহ বা কোন প্রশ্ন জাগিবার অবকাশ ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া “বাংলাদেশ” নাম গ্রহণ করায় গোলযোগের সৃষ্টি হইয়াছে। কেহ কেহ আমাদিগকে বর্তমান গ্রন্থের নাম পরিবর্তন করিতে অনুরোধ করিয়াছেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নাই। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা আবশ্যক যে ইতিহাসের দিক হইতে পূর্ববঙ্গের “বাংলাদেশ” নাম গ্রহণের কোন সমর্থন নাই। “বাংলা”র পূর্বরূপ “বাঙ্গালা” নাম মুসলমানদের দেওয়া-নামটি বাংলার একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম “বঙ্গাল” শব্দের অপভ্রংশ, ইহা “বঙ্গ” শব্দের মুসলমান রূপ নহে। মুসলমানেরা প্রথম হইতেই সমগ্র বঙ্গদেশকে মুলুক বাঙ্গালা বলিত। চতুর্দ্দশ শতাব্দী হইতেই “বাঙ্গালা” (Bangalah) শব্দটি গৌড় রাজ্য বা লখনৌতি রাজ্যের প্রতিশব্দরূপে বিভিন্ন সমসাময়িক মুসলিম গ্রন্থে (যেমন ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’) ব্যবহৃত হইয়াছে। পরে হিন্দুরাও দেশের এই নাম ব্যবহার করেন। পর্তুগীজরা যখন এদেশে আসেন তখন সমগ্র (পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ) বঙ্গদেশের এই ‘বাঙ্গালা’ নাম গ্রহণ করিয়া ইহাকে বলেন ‘Bengala’ পরে ইংরেজেরা ইহার ঈষৎ পরিবর্তন করিয়া লেখেন ‘Banglah’। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে ইংরেজের আমলে যে দেশ Bengal বলিয়া অভিহিত হইত, মুসলমান শাসনের প্রথম হইতেই সেই সমগ্র দেশের নাম ছিল বাঙ্গালা–বাংলা। সুতরাং বাংলা দেশ ইংরেজ আমলের Bengal প্রদেশের নাম–ইহার কোন এক অংশের নাম নয়। বঙ্গদেশের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সকল অংশের লোকেরাই চিরকাল বাঙালী বলিয়াই নিজেদের পরিচয় দিয়াছে, আজও দেয়। ইহাও সেই প্রাচীন বঙ্গাল ও মুসলমানদের মুলুক ‘বাঙ্গালা’ নামই স্মরণ করাইয়া দেয়। আজ পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাঙালী বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে না ইহাও যেমন অদ্ভুত, অসঙ্গত ও হাস্যকর, ‘বাংলাদেশ’ বলিলে কেবল পূর্ববঙ্গ বুঝাইবে ইহাও দ্রুপ অদ্ভুত, অসঙ্গত ও হাস্যকর।
দীর্ঘকাল ধরিয়া বাঙ্গালা, বাংলাদেশ, বাঙালী শব্দগুলি সমগ্র Bengal বা বাংলা অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার পর আজ হঠাৎ কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গকে (যাহা আদিতে মুসলমানদের “বাঙ্গালা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।–”বঙ্গ ওয়া বাঙ্গালাহ” তাঁহার প্রমাণ), “বাংলাদেশ” বলিতে হইবে এরূপ ব্যবস্থা বা ঘোষণা করার অধিকার কোন গভর্নমেন্টের নাই। উপরে উল্লিখিত কারণগুলি ছাড়া আরও একটি কারণে ইহা অযৌক্তিক। অবিভক্ত বাংলা দেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির গঠনে যাহারা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী অধিবাসী তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের অবদানও যথেষ্ট ছিল। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়া “বাংলাদেশ” ও ইহার অধিবাসীদের বাদ দিয়া “বাঙালী জাতি” কল্পনা করা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য লর্ড কার্জন যখন বাংলাকে দুই ভাগ করিয়াছিলেন, তখন পশ্চিম অংশেরই নাম রাখিয়াছিলেন Bengal অর্থাৎ “বাংলা”। বর্তমান বাংলা দেশ তখন পূর্ববঙ্গ (East Bengal) বলিয়া অভিহিত হইত।