হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে আমি যাহা লিখিয়াছি-রাজনীতিক দলের বাহিরে অনেকেই তাঁহার সমর্থন করেন–কিন্তু প্রকাশ্যে বলিতে সাহস করেন না। তবে সম্প্রতি ইহার একটি ব্যতিক্রম দেখিয়া সুখী হইয়াছি। এই গ্রন্থের যে অংশে হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি তাহা মুদ্রিত হইবার পরে প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি প্রবন্ধ পড়িলাম। বড়বাবু’ নামক গ্রন্থে চারি মাস পূর্বে ইহা প্রকাশিত হইয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই যে কিরূপ নিষ্ঠার সহিত পরস্পরের সংস্কৃতির সহিত কোনও রূপ পরিচয় স্থাপন করিতে বিমুখ ছিল, আলী সাহেব তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গপ্রধান সরস রচনায় তাঁহার বর্ণনা করিয়াছেন। কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করিতেছিঃ
“ষড়দর্শননির্মাতা আর্য্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমনের পর সাত শত বৎসর ধরে আপন আপন চতুষ্পঠীতে দর্শনচর্চ্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ঐ সাত শত বৎসর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লতনিজম্ তথা কিন্দী, ফারাবী বুআলীসিনা (লাতিনে আভিসেনা), অল গাজ্জালী (লাতিনে অল-গাজেল), আবুরুশ (লাতিনে আভের) ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শনচর্চ্চা হল তার কোনো সন্ধান পেলেন না। এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাতো আরিস্ত তলের দর্শনচর্চ্চায় সোৎসাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি এক বারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পঠীতে কিসের চর্চ্চা হচ্ছে। …এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক সুশ্রুতের আরবী অনুবাদে পুষ্ট বুআলীসিনার চিকিৎসাশাস্ত্র..আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিৎসার্থে প্রয়োগ করেছেন, সেই চরক সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ান হচ্ছে তারই সন্ধান তিনি পেলেন না।…পক্ষান্তরে ভারতীয় আয়ুর্বেদ মুসলমানদের ইউনানী চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বিশেষ কিছু নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।… শ্রীচৈতন্যদেব নাকি ইসলামের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন…কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্ম্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। বস্তুত তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুধর্ম্মের সংগঠন ও সংস্কার, এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নবযৌবনের পথে নিয়ে যাবার।* [*এই গ্রন্থের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে-ধর্ম ও সমাজ অংশে আমিও এই মত ব্যক্তি করিয়াছি।] …মুসলমান যে জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মদর্শন সঙ্গে এনেছিলেন, এবং পরবর্তী যুগে বিশেষ করে মোগল আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মঙ্গোল-জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র কবি পণ্ডিত ধর্মজ্ঞ দার্শনিক এদেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন আপন কবিত্ব পাণ্ডিত্য নিঃশেষে উজাড় করে দিলেন তার থেকে এ দেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, দার্শনিক কণামাত্র লাভবান হন নি।…হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি।’
সৈয়দ মুজতবা আলীর এই উক্তি আমি আমার মতের সমর্থক প্রমাণ স্বরূপ উদ্ধৃত করি নাই। কিন্তু একদিকে যেমন রাজনীতির প্রভাবে হিন্দু মুসলমানের সংস্কৃতির মধ্যে একটি কাল্পনিক মিলনক্ষেত্রের সৃষ্টি হইয়াছে, তেমনি একজন মুসলমান সাহিত্যিকের মানসিক অনুভূতি যে ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করে ইহা দেখানই আমার উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিক আলোচনার দ্বারা আমি যে সত্যের সন্ধান পাইয়াছি, তাহা রাজনীতিক বাঁধা বুলির অপেক্ষা এই সাহিত্যিক অনুভূতিরই বেশি সমর্থন করে। আমার মত যে অভ্রান্ত এ কথা বলি না। কিন্তু প্রচলিত মতই যে সত্য তাহাও স্বীকার করি না। বিষয়টি লইয়া নিরপেক্ষভাবে ঐতিহাসিক প্রণালীতে আলোচনা করা প্রয়োজন-এবং এই গ্রন্থে আমি কেবলমাত্র তাহাই চেষ্টা করিয়াছি। আচার্য যদুনাথ ঐতিহাসিক সত্য নির্ধারণের যে আদর্শ আমাদের সম্মুখে ধরিয়াছেন তাহা অনুসরণ করিয়া চলিলে হয়ত প্রকৃত সত্যের সন্ধান মিলিবে। এই গ্রন্থ যদি সেই বিষয়ে সাহায্য করে তাহা হইলেই আমার শ্রম সার্থক মনে করিব।
এই গ্রন্থের ‘শিল্প’ অধ্যায় প্রণয়নে শ্রীযুক্ত শ্রীঅমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রণীত ‘বাঁকুড়ার মন্দির’ হইতে বহু সাহায্য পাইয়াছি। তিনি অনেকগুলি ফটোও দিয়াছেন। এইজন্য তাঁহার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি। আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টও বহু ফটো দিয়াছেন–ইহার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। স্থানান্তরে কোন্ ফটোগুলি কাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত, তাঁহার উল্লেখ করিয়াছি।
মধ্যযুগের বাংলায় মুসলমানদের শিল্প সম্বন্ধে ঢাকা হইতে প্রকাশিত এ এ দানীর গ্রন্থ হইতে বহু সাহায্য পাইয়াছি। এই গ্রন্থে মুসলমানগণের বহুসংখ্যক সৌধের বিস্তৃত বিবরণ ও চিত্র আছে। হিন্দুদের শিল্প সম্বন্ধে এই শ্রেণীর কোন গ্রন্থ নাই–এবং হিন্দু মন্দিরগুলি চিত্র সহজলভ্য নহে। এই কারণে শিল্পের উৎকর্ষ হিসাবে মুসলমান সৌধগুলি অধিকতর মূল্যবান হইলেও হিন্দু মন্দিরের চিত্রগুলি বেশি সংখ্যায় এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।
পূর্বেই বলিয়াছি যে মধ্যযুগের বাংলার সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস ইতিপূর্বে লিখিত হয় নাই। সুতরাং আশা করি এ বিষয়ে এই প্রথম প্রয়াস বহু দোষত্রুটি সত্ত্বেও পাঠকদের সহানুভূতি লাভ করিবে।