একুশ বৎসর পূর্বে মৎসম্পাদিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ইংরেজী ভাষায় লিখিত বাংলার ইতিহাস প্রথম ভাগ (History of Bengal Vol. I. 1943) অবলম্বনে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ লিখিয়াছিলাম। ইংরেজী বইয়ের অনুকরণে এই বাংলা গ্রন্থেও রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক উভয়বিধ ইতিহাসের আলোচনা ছিল। এই গ্রন্থের এ যাবৎচারিটি সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহা এই শ্রেণীর ইতিহাসের জনপ্রিয়তা ও প্রয়োজনীয়তা সূচিত করে–এই ধারণার বশবর্তী হইয়া আমার পরম স্নেহাস্পদ ভূতপূর্ব ছাত্র এবং পূর্ব্বোক্ত বাংলা দেশের ইতিহাসের প্রকাশক শ্রীমান সুরেশচন্দ্র দাস, এম. এ. আমাকে একখানি পূর্ণাঙ্গ মধ্যযুগের ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ লিখিতে অনুরোধ করে। কিন্তু এই গ্রন্থ লেখা অধিকতর দুরূহ মনে করিয়া আমি নিবৃত্ত হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত বাংলার ইতিহাস-প্রথম ভাগে রাজনীতিক ও সামাজিক ইতিহাস উভয়ই আলোচিত হইয়াছিল –সুতরাং মোটামুটি ঐতিহাসিক উপকরণগুলি সকলই সহজলভ্য ছিল। কিন্তু মধ্যযুগের রাজনীতিক ইতিহাস থাকিলেও সাংস্কৃতিক ইতিহাস এ যাবৎ লিখিত হয় নাই। অতএব তাহা আগাগোড়াই নূতন করিয়া অনুশীলন করিতে হইবে। আমার পক্ষে বৃদ্ধ বয়সে এইরূপ শ্রমসাধ্য কার্যে হস্তক্ষেপ করা যুক্তিযুক্ত নহে বলিয়াই সিদ্ধান্ত করিলাম। কিন্তু শ্রীমান সুরেশের নির্বন্ধাতিশয্যে এবং দুইজন সহযোগী সাগ্রহে আংশিক দায়িত্বভার গ্রহণ করায় আমি এই কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি। একজন আমার ভূতপূর্ব ছাত্র অধ্যাপক শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায়। ইহাদের সহায়তার জন্য আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।
বর্তমানকালে বাংলা দেশের–তথা ভারতের–মধ্যযুগের সংস্কৃতি বা সমাজের ইতিহাস লেখা খুবই কঠিন। কারণ এ বিষয়ে নানা প্রকার বদ্ধমূল ধারণা ও সংস্কারের প্রভাবে ঐতিহাসিক সত্য উপলব্ধি করা দুঃসাধ্য হইয়াছে। এই শতকের গোড়ার দিকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামে যাহাতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই যোগদান করে, সেই উদ্দেশ্যে হিন্দু রাজনীতিকেরা হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে কতকগুলি সম্পূর্ণ নূতন “তথ্য প্রচার করিয়াছেন। গত ৫০/৬০ বৎসর যাবৎ ইহাদের পুনঃপুনঃ প্রচারের ফলে এ বিষয়ে কতকগুলি বাঁধা গৎ বা বুলি অনেকের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়াছে। ইহার মধ্যে যেটি সর্বাপেক্ষা গুরুতর–অথচ ঐতিহাসিক সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত-ত্রয়োদশ অধ্যায়ের-হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সম্বন্ধ অংশে আলোচনা করিয়াছি। ইহার সারমর্ম এই যে ভারতের প্রাচীন হিন্দু-সংস্কৃতি লোপ পাইয়াছে এবং মধ্যযুগে মুসলিম সংস্কৃতির সহিত সমন্বয়ের ফলে এমন এক সম্পূর্ণ নূতন সংস্কৃতির আবির্ভাব হইয়াছে, যাহা হিন্দুও নহে মুসলমানও নহে। মুসলমানেরা অবশ্য ইহা স্বীকার করেন না এবং ইসলামীয় সংস্কৃতির ভিত্তির উপরই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত, ইহা প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়াছেন। কিন্তু ভারতে হিন্দু-সংস্কৃতি’ এই কথাটি এবং ইহার অন্তর্নিহিত ভাবটি উল্লেখ করিলেই তাহা সংকীর্ণ অনুদার সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির পরিচায়ক বলিয়া গণ্য করা হয়। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা এই মতের সমর্থন করে কিনা তাঁহার কোনরূপ আলোচনা না করিয়াই কেবলমাত্র বর্তমান রাজনীতিক তাগিদে এই সব বুলি বা বাঁধা গৎ ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। একজন সর্বজনমান্য রাজনৈতিক নেতা বলিয়াছেন যে অ্যাংলো-স্যাকসন, জুট, ডেন ও নর্মান প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির মিলনে যেমন ইংরেজ জাতির উদ্ভব হইয়াছে, ঠিক সেইরূপে হিন্দু-মুসলমান একেবারে মিলিয়া (coalesced) একটি ভারতীয় জাতি গঠন করিয়াছে। আদর্শ হিসাবে ইহা যে সম্পূর্ণ কাম্য, তাহাতে সন্দেহ নাই-কিন্তু ইহা কতদূর ঐতিহাসিক সত্য, তাহা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এই জন্যই এই প্রসঙ্গটি এই গ্রন্থে আলোচনা করিতে বাধ্য হইয়াছি। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ঐতিহাসিক প্রণালীতে বিচারের ফলে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, তাহা অনেকেই হয়ত গ্রহণ করিবেন না। কিন্তু “বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ” একই নীতিবাক্য স্মরণ করিয়া আমি যাহা প্রকৃত সত্য বলিয়া বুঝিয়াছি, তাহা অসঙ্কোচে ব্যক্ত করিয়াছি। এই প্রসঙ্গে ৫১ বৎসর পূর্বে আচার্য যদুনাথ সরকার বর্ধমান সাহিত্য সম্মিলনের ইতিহাস-শাখার সভাপতির ভাষণে যাহা বলিয়াছিলেন, তাঁহার কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি :
“সত্য প্রিয়ই হউক, আর অপ্রিয়ই হউক, সাধারণের গৃহীত হউক আর প্রচলিত মতের বিরোধী হউক, তাহা ভাবিব না। আমার স্বদেশগৌরবকে আঘাত করুক আর না করুক, তাহাতে ভ্রূক্ষেপ করিব না। সত্য প্রচার করিবার জন্য, সমাজের বা বন্ধুবর্গের মধ্যে উপহাস ও গঞ্জনা সহিতে হয়, সহিব। কিন্তু তবুও সত্যকে খুঁজিব, গ্রহণ করিব। ইহাই ঐতিহাসিকের প্রতিজ্ঞা।”
এই আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি, তাহা অনেকেরই মনঃপূত হইবে না ইহা জানি। তাঁহাদের মধ্যে যাহারা ইহার ঐতিহাসিক সত্য স্বীকার করেন, তাঁহারাও বলিবেন যে এরূপ সত্য প্রচারে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও জাতীয় একীকরণের (National integration) বাধা জন্মিবে। একথা আমি মানি না। মধ্যযুগের ইতিহাস বিকৃত করিয়া কল্পিত হিন্দু-মুসলমানের ভ্ৰাতৃভাব ও উভয় সংস্কৃতির সমন্বয়ের কথা প্রচার করিয়া বেড়াইলেই ঐ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না। সত্যের দৃঢ় প্রস্তরময় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা না করিয়া কাল্পনিক মনোহর কাহিনীর বালুকার স্তূপের উপর এইরূপ মিলন-সৌধ প্রস্তুত করিবার প্রয়াস যে কিরূপ ব্যর্থ হয় পাকিস্তান তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।