স্নেহপরায়ণ পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং রণক্ষেত্রে তাঁহাকে পরাজিত ও নিহত করিয়া সিংহাসন অধিকার গিয়াসুদ্দীনের চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করিয়াছে সন্দেহ নাই। তবে বিমাতার চক্রান্ত হইতে নিজেকে রক্ষা করিবার জন্য অনেকাংশে বাধ্য হইয়াই গিয়াসুদ্দীন এইরূপ আচরণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। এই দিক দিয়া বিচার করিলে তাহাকে সম্পূর্ণভাবে না হইলেও আংশিকভাবে ক্ষমা করা যায়।
গিয়াসুদ্দীন যে কতখানি রসিক ও কাব্যামোদী ছিলেন, তাহা তাঁহার একটি কাজ হইতে বুঝিতে পারা যায়। এ সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ যাহা লেখা আছে, তাঁহার সারমর্ম এই। একবার গিয়াসুদ্দীন সাংঘাতিক রকম অসুস্থ হইয়া পড়িয়া বাঁচিবার আশা ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং সর্ব, গুল ও লালা নামে তাঁহার হারেমের তিনটি নারীকে তাঁহার মৃত্যুর পর শবদেহ ধৌত করার ভার দিয়াছিলেন। কিন্তু সেবারে তিনি সুস্থ হইয়া উঠেন এবং তাঁহার পর ঐ তিনটি নারীকে হারেমের অন্যান্য নারীরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করিতে থাকে। ঐ তিনটি নারী সুলতানকে এই কথা জানাইলে সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের নামে একটি ফার্সী গজল লিখিতে সুরু করেন। কিন্তু এক ছত্রের বেশি তিনি আর লিখিতে পারেন নাই, তাঁহার রাজ্যের কোন কবিও ঐ গজলটি পূরণ করিতে পারেন নাই। তখন গিয়াসুদ্দীন ইরানের শিরাজ শহরবাসী অমর কবি হাফিজের নিকট ঐ ছত্রটি পাঠাইয়া দেন। হাফিজ উহা পূরণ করিয়া ফেরৎ পাঠান।
এই কাহিনীর প্রথমাংশের খুঁটিনাটি বিবরণগুলি সব সত্য কিনা তাহা বলা যায়, তবে দ্বিতীয়াংশ অর্থাৎ হাফিজের কাছে গিয়াসুদ্দীন কর্ত্তৃক গজলের এক ছত্র পাঠানো এবং হাফিজের তাহা সম্পূর্ণ করিয়া পাঠানো সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’তেও এই ঘটনাটি সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে। ‘রিয়াজ’ ও ‘আইন’-এ এই গজলটির কয়েক ছত্র উদ্ধৃত হইয়াছে, সেইগুলি সমেত সম্পূর্ণ গজলটি (হাফিজের মৃত্যুর অল্প পরে তাঁহার অন্তরঙ্গ বন্ধু মুহম্মদ গুল অাম কর্ত্তৃক সংকলিত) দিওয়ান-ই-হাফিজে পাওয়া যায়, তাহাতে সুলতান গিয়াসুদ্দীন ও বাংলাদেশের নাম আছে।
গিয়াসুদ্দীনের ন্যায়নিষ্ঠা সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ একটি কাহিনী লিপিবদ্ধ হইয়াছে। সেটি এই। একবার গিয়াসুদ্দীন তীর ছুঁড়িতে গিয়া আকস্মিকভাবে এক বিধবার পুত্রকে আহত করিয়া বসেন। ঐ বিধবা কাজী সিরাজুদ্দীনের কাছে এ সম্বন্ধে নালিশ করে। কর্তব্যনিষ্ঠ কাজী তখন পেয়াদার হাত দিয়া সুলতানের কাছে সমন পাঠান। পেয়াদা সহজ পথে সুলতানের কাছে সমন লইয়া যাওয়ার উপায় নাই দেখিয়া অসময়ে আজান দিয়া সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখন সুলতানের কাছে পেয়াদাকে লইয়া যাওয়া হইলে সে তাহাকে সমন দিল। সুলতান তৎক্ষণাৎ কাজীর আদালতে উপস্থিত হইলেন। কাজী তাঁহাকে কোন খাতির না দেখাইয়া বিধবার ক্ষতিপূরণ করিতে নির্দেশ দিলেন। সুলতান সেই নির্দেশ পালন করিলেন। তখন কাজী উঠিয়া দাঁড়াইয়া সুলতানকে যথোচিত সম্মান দেখাইয়া মসনদে বসাইলেন। সুলতানের বগলের নীচে একটি ছোট তলোয়ার লুকানো ছিল, সেটি বাহির করিয়া তিনি কাজীকে বলিলেন যে তিনি সুলতান বলিয়া কাজী যদি বিচারের সময় তাঁহার প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাইতেন, তাহা হইলে তিনি তলোয়ার দিয়া কাজীর মাথা কাটিয়া ফেলিতেন। কাজীও তাঁহার মসনদের তলা হইতে একটি বেত বাহির করিয়া বলিলেন, সুলতান যদি আইনের নির্দেশ লঙ্ঘন করিতেন, তাহা হইলে আদালতের বিধান অনুসারে তিনি এ বেত দিয়া তাঁহার পিঠ ক্ষতবিক্ষত করিতেন –ইহার জন্য তাঁহাকে বিপদে পড়িতে হইবে জানিয়াও। তখন সুলতান অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কাজীকে অনেক উপহার ও পারিতোষিক দিয়া ফিরিয়া আসিলেন।
এই কাহিনীটি সত্য কিনা তাহা বলা যায় না। তবে সত্য হওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব। কারণ গিয়াসুদ্দীনকে লেখা বিহারের দরবেশ মুজাফফর শামস বলখির চিঠি হইতে জানা যায় যে গিয়াসুদ্দীন সত্যই ন্যায়নিষ্ঠ ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। বল্খির চিঠি হইতে জানা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন প্রথম দিকে সুখ এবং আমোদ-প্রমোদে নিমগ্ন ছিলেন, কিন্তু বলখির সহিত পত্রালাপের সময় তিনি পবিত্র ও ধর্মনিষ্ঠ জীবন যাপন করিতেছিলেন। গিয়াসুদ্দীন বিদ্যা, মহত্ত্ব, উদারতা, নির্ভীকতা প্রভৃতি গুণে ভূষিত ছিলেন এবং সেজন্য তিনি রাজা হিসাবে জনপ্রিয় হইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দীন কবিও ছিলেন এবং সুন্দর গজল লিখিয়া মুজাফফর শামস্ বলখিকে পাঠাইতেন।
বখি ভিন্ন আর একজন দরবেশের সহিত গিয়াসুদ্দীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি আলা অল-হকের পুত্র নূর কুত্ত্ব আলম। ‘রিয়াজ’-এর মতে ইনি গিয়াসুদ্দীনের সহপাঠী ছিলেন। গিয়াসুদ্দীন ও নূর কুত্ আলম উভয়ে পরস্পকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন। কথিত আছে, নূর কুত্ত্ব আলমের ভ্রাতা আজম খান সুলতানের উজীর ছিলেন; তিনি নূর কুত্ত্বকে একটি উচ্চ রাজপদ দিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু নূর কুত্ত্ব তাহাতে রাজী হন নাই।
মুজাফফর শামস্ বখি ও নূর কুত্ত্ব আলমের সহিত গিয়াসুদ্দীনের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হইতে বুঝিতে পারা যায়, গিয়াসুদ্দীনও পিতা ও পিতামহের মত সাধুসন্ত দের ভক্ত ছিলেন। তাঁহার ধর্মনিষ্ঠার অন্য নিদর্শনও আমরা পাই। অলসখাওয়ী এবং গোলাম আলী আজাদ বিলগ্রামী নামে দুইজন প্রামাণিক গ্রন্থকারের লেখা হইতে জানা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন অনেক টাকা খরচ করিয়া মক্কা ও মদিনায় দুইটি মাদ্রাসা নির্মাণ করাইয়া দিয়াছিলেন। মক্কার মাদ্রাসাটি নির্মাণ করিতে বার হাজার মিশরী স্বর্ণ-মিথকল লাগিয়াছিল। গিয়াসুদ্দীন নিজে হানাফী ছিলেন কিন্তু মক্কার মাদ্রাসায় তিনি হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হানবালী মুসলিম সম্প্রদায়ের এই চারিটি মজুহবের জন্যই বক্তৃতার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ইহা ভিন্ন গিয়াসুদ্দীন মক্কাতে একটি সরাইও নির্মাণ করান এবং মাদ্রাসা ও সরাইয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য এই দুই প্রতিষ্ঠানকে বহুমূল্যের সম্পত্তি দান করেন। তিনি মক্কার আরাফাহ্ নামক স্থানে একটি খাল খনন করাইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দিন মক্কায় য়াকুৎ অনানী নামক এক ব্যক্তিকে পাঠাইয়াছিলেন, ইনিই এই সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। গিয়াসুদ্দীন মক্কা ও মদিনার লোকদের দান করিবার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠাইয়াছিলেন, তাঁহার এক অংশ মক্কা শরীফ গ্রহণ করেন এবং অবশিষ্টাংশ হইতে মক্কা ও মদিনার প্রতিটি লোককেই কিছু কিছু দেওয়া হয়।