ইলিয়াস শাহ ৭৫৯ হিজরায় (১৩৫৮-৫৯ খ্রী) পরলোকগমন করেন।
৫
সিকন্দর শাহ
ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার সুযোগ্য পুত্র সিকন্দর শাহ সিংহাসনে বসেন। তিনি সুদীর্ঘ তেত্রিশ বৎসর (আনুমানিক ১৩৫৮ হইতে ১৩৯১ খ্রী পর্যন্ত) রাজত্ব করেন। বাংলার আর কোন সুলতান এত বেশি দিন রাজত্ব করেন নাই।
সিকন্দর শাহের রাজত্বকালে ফিরোজ শাহ তুগলক আবার বাংলা দেশ আক্রমণ করেন। পূর্ব্বোল্লিখিত ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’ এবং শামস্-ই-সিরাজ আফিফের ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ হইতে এই আক্রমণ ও তাঁহার পরিণামের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। আফিফ লিখিয়াছেন যে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের জামাতা জাফর খান দিল্লিতে গিয়া ফিরোজ শাহের কাছে অভিযোগ করেন যে ইলিয়াস শাহ তাঁহার শ্বশুরের রাজ্য কাড়িয়া লইয়াছেন; ফিরোজ শাহ তখন ইলিয়াসকে শাস্তি দিবার জন্য এবং জাফর খানকে শ্বশুরের রাজ্যের সিংহাসনে বসাইবার জন্য বাংলা দেশে অভিযান করেন। কিন্তু যখন তিনি বাংলাদেশে পৌঁছান, তখন ইলিয়াস শাহ পরলোকগমন করিয়াছিলেন এবং সিকন্দর শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। সুতরাং সিকন্দর শাহের সহিতই ফিরোজ শাহের সংঘর্ষ হইল।
আফিফ এবং ‘সিরাৎ’ হইতে জানা যায় যে, সিকন্দর ফিরোজ শাহের সহিত সম্মুখযুদ্ধ না করিয়া একডালা দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। ফিরোজ শাহ অনেক দিন একডালা দুর্গ অবরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু দুর্গ অধিকার করিতে পারেন নাই। অবশেষে উভয় পক্ষই ক্লান্ত হইয়া পড়িলে সন্ধি স্থাপিত হয়।
আফিফ ও ‘সিরাৎ’-এর মতে সিকন্দর শাহের পক্ষ হইতেই প্রথমে সন্ধি প্রার্থনা করা হইয়াছিল। কিন্তু ইহা সত্য বলিয়া মনে হয় না। কারণ সন্ধির ফলে ফিরোজ শাহ কোন সুবিধাই লাভ করিতে পারেন নাই। পরবর্তী ঘটনা হইতে দেখা যায়, তিনি বাংলা দেশের উপর সিকন্দর সাহের সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন এবং সমকক্ষ রাজার মতই তাঁহার সঙ্গে দূত ও উপঢৌকন বিনিময় করিয়াছিলেন। আফিফের মতে সিকন্দর শাহ জাফর খানকে সোনারগাঁও অঞ্চল ছাড়িয়া দিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু জাফর খান বলেন যে, তাঁহার বন্ধুবান্ধবের সকলেই নিহত হইয়াছে, সেইজন্য তিনি সোনারগাঁওয়ে নিরাপদে থাকিতে পারিবেন না; এই কারণে তিনি ঐ রাজ্য গ্রহণে স্বীকৃত হইলেন না। ফিরোজ শাহের এই দ্বিতীয় বঙ্গাভিযান শেষ হইতে দুই বৎসর সাত মাস লাগিয়াছিল।
সিকন্দর শাহের একটি বিশিষ্ট কীর্তি পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ নির্মাণ (১৩৬৯ খ্রী)। স্থাপত্য-কৌশলের দিক দিয়া এই মসজিদটি অতুলনীয়। ভারতবর্ষে নির্মিত সমস্ত মসজিদের মধ্যে আদিনা মসজিদ আয়তনের দিক হইতে দ্বিতীয়।
পিতার মত সিকন্দর শাহও মুসলিম সাধুসন্তদের ভক্ত ছিলেন। দেবীকোটের বিখ্যাত সন্ত মুল্লা আতার সমাধিতে তিনি একটি মসজিদ তৈরি করাইয়াছিলেন। তাঁহার সমসাময়িক পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত দরবেশ আলা অল-হকের সহিতও তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল।
সিকন্দরের শেষ জীবন সম্বন্ধে ‘রিয়াজ’-এ একটি করুণ কাহিনী লিপিবদ্ধ হইয়াছে। কাহিনীটির সারমর্ম এই। সিকন্দর শাহের প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে সতেরটি পুত্র ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে একটিমাত্র পুত্র জন্মগ্রহণ করে। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র গিয়াসুদ্দীন সব দিক দিয়াই যোগ্য ছিলেন। ইহাতে সিকন্দরের প্রথমা স্ত্রীর মনে প্রচণ্ড ঈর্ষা হয় এবং তিনি গিয়াসুদ্দীনের বিরুদ্ধে সিকন্দর শাহের মন বিষাইয়া দিবার চেষ্টা করেন। তাহাতে সিকন্দর শাহের মন একটু টলিলেও তিনি গিয়াসুদ্দীনকেই রাজ্য শাসনের ভার দেন। গিয়াসুদ্দীন কিন্তু বিমাতার মতিগতি সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া সোনারগাঁওয়ে চলিয়া যান। কিছুদিনের মধ্যে তিনি এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করিলেন এবং পিতার নিকট সিংহাসন দাবি করিয়া। লখনৌতির দিকে রওনা হইলেন। গোয়ালপাড়ার প্রান্তরে পিতাপুত্রে যুদ্ধ হইল। গিয়াসুদ্দীন তাঁহার পিতাকে বধ করিতে সৈন্যদের নিষেধ করিয়াছিলেন, কিন্তু একজন সৈন্য না চিনিয়া সিকন্দরকে বধ করিয়া বসে। শেষ নিঃশ্বাস ফেলিবার আগে সিকন্দর বিদ্রোহী পুত্রকে আশীর্বাদ জানাইয়া যান।
এই কাহিনীটি সম্পূর্ণভাবে সত্য কিনা তাহা বলা যায় না, তবে পিতার বিরুদ্ধে গিয়াসুদ্দীনের বিদ্রোহ এবং পুত্রের সহিত যুদ্ধে সিকন্দরের নিহত হওয়ার কথা যে সত্য, তাঁহার অনেক প্রমাণ আছে।
ত্রিপুরার রাজাদের ইতিবৃত্ত ‘রাজমালা’য় লেখা আছে যে, ত্রিপুরার বর্তমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রত্ন-ফা (ইঁহার ১৩৬৪ হইতে ১৩৬৭ খ্রীষ্টাব্দের মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে) যখন তাঁহার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা রাজা-ফাঁকে উচ্ছেদ করিয়া ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার করিতে চাহেন, তখন তাঁহার অনুরোধে গৌড়ের “তুরুষ্ক নৃপতি” ত্রিপুরা আক্রমণ করেন এবং রাজা-ফাঁকে বিতাড়িত করিয়া রত্ন-ফাকে সিংহাসনে বসান। রত্ন-ফা “তুরুস্ক নৃপতি”র নিকট “মাণিক্য” উপাধি এবং একটি বহু মূল্য রত্ন পান। সম্ভবতঃ সিকন্দর শাহই এই “তুরুষ্ক নৃপতি”।
৬
গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ
ইলিয়াস শাহী বংশের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এই বংশের প্রথম তিনজন রাজাই অত্যন্ত যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তন্মধ্যে ইলিয়াস শাহ ও সিকন্দর শাহ যুদ্ধ ও স্বাধীনতা রক্ষার দ্বারা নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু সিকন্দর শাহের পুত্র গিয়াসুদ্দীর আজম শাহ খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন তাঁহার লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্বের জন্য। তাঁহার মত বিদ্বান, রুচিমান, রসিক ও ন্যায়পরায়ণ নৃপতি এ পর্যন্ত খুব কমই আবির্ভূত হইয়াছেন।