জামাতাকে হত্যা করার পর গোপীপ্রসাদ উদয়মাণিক্য নাম গ্রহণ করিয়া ত্রিপুরার অধীশ্বর হইয়া বসেন। সম্ভবত তিনি প্রথম সরাসরি নিজেকে রাজা বলিয়া জাহির করেন নাই, এবং বেশ কিছুদিন কাটিয়া যাওয়ার পর ১৪৮৯ শকে অভিষিক্ত হইয়া সিংহাসনে বসেন ও ত্রিপুরার ‘মাণিক্য রাজাদের মতই ‘সিংহমূর্ত্তি’ সমন্বিত মুদ্ৰানির্মাণ করেন। এই সব মুদ্রায় তারিখ হিসাবে ‘১৪৮৯’ শকাব্দ ও রাণী হীরা মহাদেবীর নাম থাকে। চক্রান্তকারী উদয় কিন্তু কয়েক বৎসর কৃতিত্বের সহিত রাজত্ব করেন। তিনি চন্দ্রপুরে রাজধানী স্থাপন করেন এবং সেখানে চন্দ্ৰসাগর নামে দীঘি খনন করেন। সম্ভবত চন্দ্রপুরকেই তিনি উদয়পুর নাম দেন। তিনি চট্টগ্রাম বিজয়েছু মুঘলসৈন্য কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন বলিয়া কথিত আছে। [রাজ, পৃ, ৭১।] রাজমালার মতে চৌদ্দশ আটানব্বই শকেতে’ ‘পঞ্চ বৎসর রাজত্ব করিয়া কামাসক্ত উদরমাণিক্য অপঘাতে মারা যান’। [রাজ. পৃ, ৭২।] কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর এই তারিখটি সত্য হইতে পারে না। ১৪৮৬ ও ১৪৮৭ শকাব্দের মধ্যে দেড় বৎসর রাজত্ব করিবার পর যদি অনন্তমাণিক্য নিহত হইয়া থাকেন এবং তাঁহার পর যদি উদয় পাঁচ বৎসর রাজত্ব করেন, তাহা হইল ১৪৯২ শকের কাছাকাছি কোন সময় উদয়ের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটিবার কথা। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তাহা ঘটে নাই বলিয়া মনে হয়। সম্ভবত অনন্তের মুদ্রার শেষ তারিখ ১৪৮৭ এবং উদয়পুত্র জয়মাণিক্যের প্রাথমিক মুদ্রায় লিখিত তারিখ ১৪৯৫ শকের মধ্যে উদয়মাণিক্য প্রায় ৭।৮ বৎসর রাজত্ব করেন।
উদয়ের পর তাঁহার পুত্র প্রথম জয়মাণিক্য ১৪৯৫ শকে বা তাঁহার কিছু পূর্বে সিংহাসনে বসেন এবং ১৪৯৫ শকের তারিখ দিয়া মুদ্রা নির্মাণ করে। এই সব মুদ্রার কতকগুলিতে শুধুমাত্র তাঁহার একার নাম থাকিলেও কতকগুলিতে আবার তাঁহার মহিষী সুভদ্রা মহাদেবীর নাম দেখা যায়। জয়মাণিক্য দেবমাণিক্যের পুত্র অমরমাণিক্য কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন।
রাজমালার মতে ‘চৌদ্দ শ’ ঊনশত শকে অমরদেব রাজা হন’, [রাজ, ৩য়, পৃ. ১১] এবং ঐ বৎসরই আমরা অমরমাণিক্যকে মহিষী অমরাবতীর নাম সম্বলিত মুদ্রা নির্মাণ করিতে দেখি। রাজমালায় ১৫০০ শকে তৎকর্ত্তৃক ‘ভুলুয়া আমল’ করার কথা আছে। [রাজ, ৩য়, পৃ. ১১।] ১৫০২ শকাব্দের এক প্রকার মুদ্রায় তিনি ‘দিগ্বিজয়ী’ এই বিরূদ ব্যবহার করেন এবং পরবৎসরে উত্তীর্ণ তাঁহার শেষ মুদ্রায় আপনাকে ‘শ্রীহট্টবিজয়ী’ বলিয়া ঘোষণা করেন। ‘রাজমালাতেও তাঁহার এই শ্রীহট্ট বিজয়ের কথা আছে; তবে ইহার কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে যুবরাজ রাজধরেরই ছিল বলিয়া জানা যায়। [রাজ, পৃ. ৪৭-৪৯ দ্রষ্টব্য।] অমরমাণিক্য শেষপর্যন্ত কুকীদের দ্বারা বিপর্যস্ত হন এবং কিছুদিনের মধ্যে আত্মহত্যা করেন। [রাজ, পৃ. ৬১ এবং ৬৩ দ্রষ্টব্য।]
অমরমাণিক্যের পর তৎপুত্র রাজধরমাণিক্য রাজা হন এবং ১৫০৮ শকে মহিষী সত্যবতীর সহিত মুদ্রা নির্মাণ করেন। রাজমালার লেখা অনুযায়ী তিনি ১২ বৎসর রাজত্ব করেন; [রাজ, পৃ. ২১৩ দ্রষ্টব্য] কিন্তু রাজমালার বৃত্তান্ত পাঠে ও তৎপুত্র যশোধরের ১৫২২ শকের প্রাথমিক মুদ্রা দৃষ্টে বেশ বোঝা যায় যে, তিনি প্রায় ১৫ বৎসর সিংহাসনারূঢ় ছিলেন।
যাহা হউক, ১৫২২ শকে বা তাঁহার কিছু পূর্বে রাজধরের পরেই যশোধরমাণিক্য অভিষিক্ত হন। তাঁহার ১৫২২ শকের ‘বংশীবাদক কৃষ্ণের মূর্ত্তি’ সমন্বিত মুদ্রার কথা ইতিপূর্বেই বলা হইয়াছে। এই মুদ্রাগুলির একটিতে শুধু মহিষী ‘লক্ষ্মীর’ [ভারতীয় মুদ্রার সুবিখ্যাত সংগ্রাহক শেঠ হনুমান প্রসাদ পোদ্দার মহাশয়ের সগ্রহে রক্ষিত এই মুদ্রাটি শীঘ্রই লেখক কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইবে] এবং বাকীগুলির কোনটিতে ‘গৌরী ও লক্ষ্মীর’ ও কোনটিতে আবার ‘লক্ষ্মী, গৌর ও জয়া’ মহাদেবীর নাম দেখা যায়। অনন্য যে মুদ্রাটিতে শুধুমাত্র লক্ষ্মীর নাম আছে, তাঁহার গৌণদিকে কৃষ্ণের পার্শ্বেও শুধু ‘একজন’ গোপিনীর মূর্ত্তি দেখা যায়; বাকীগুলিতে কিন্তু কৃষ্ণের দুই পার্শ্বে দুইজন গোপিনী থাকেন। যাহা হউক, শেষপর্যন্ত যশোধরমাণিক্য বাংলার সমসাময়িক মুসলমান সুলতান কর্ত্তৃক পরাজিত, ধৃত এবং প্রথমে কাশীতে ও পরে মথুরায় নির্বাসিত হন। ১৫৪৫ শকের কাছাকাছি কোন সময়ে যশোধরমাণিক্যের মৃত্যু হইয়া থাকিবে। তাঁহার মৃত্যুর পর ত্রিপুরা রাজ্য আড়াই বৎসর মুসলমানদের অধীনে থাকিবার পর মহামাণিক্যের পুত্র গগনফার বংশজ কল্যাণমাণিক্য ১৫৪৭ শকাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন এবং পর বৎসরের তারিখ দিয়া মুদ্রা নির্মাণ করেন। [রাজ, ৩য়, পৃ. ৬৬ : পরশ সাতচল্লিশ শকে রাজা হৈল। শুভদিনে মহারাজ মোহর মারিল।] এযাবৎ প্রাপ্ত তাঁহার ক্ষুদ্রাকৃতি মুদ্রাগুলিতে তাঁহার একারই নাম পাওয়া যাইত। কিন্তু সম্প্রতি আমরা তাঁহার একটি পূর্ণ টঙ্কের যে প্রতিকৃতি পাইয়াছি, তাহাতে তাঁহার মহিষী কলাবতীরও নাম আছে। রাজমালায় কল্যাণের মহিষী হিসাবে ‘কলাবতী’ ও ‘সহরবতী’র নাম পাওয়া যায়। [মুদ্রাটি বিলাতের একটি সংগ্রহশালায় আছে। কল্যাণ-মহিষীদের সম্বন্ধে ঐ, পৃ. ১৫৫ ও প্রথম পাদটিকা এবং পৃ. ১৫৬ ও তৃতীয় পাদটিকা দ্রষ্টব্য।] ১৫৮২ শকাব্দে বা তাঁহার কিছু পূর্বে কল্যাণের মৃত্যু হয়, এবং ঐ বৎসরই আমরা তাঁহার পুত্র গোবিন্দমাণিক্যকে মুদ্রা নির্মাণ করিতে দেখি। গোবিন্দের রাজত্ব প্রথম দিকে নিরঙ্কুশ ছিল না; বৈমাত্রেয় ভ্রাতা নক্ষত্র রায় সাময়িকভাবে তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া রাজা হন এবং ছত্রমাণিক্য নাম লইয়া ১৫৮৩ শকের তারিখ সম্বলিত মুদ্রা নির্মাণ করেন। কিন্তু গোবিন্দ যে শীঘ্রই সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন, তাঁহার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫৮৩ শকে উল্কীর্ণ তাঁহার একখানি শিলালেখ হইতে। [শিলালেখ-সংগ্রহ, পৃ. ২৬।] ইহার পর ঠিক কতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, তাহা অনুমান সাপেক্ষ। ১৫৯৮ শকের কাছাকাছি কোন সময় তাঁহার মৃত্যু হইয়া থাকিবে, কারণ গোবিন্দের পুত্র ও পরবর্তী রাজা রামদেবমাণিক্য ঐ তারিখেই মহিষী রত্নাবতীর নামসম্বলিত মুদ্রা নির্মাণ করেন। রামদেবের নামযুক্ত কয়েকটি শিলালেখের মধ্যে শেষটি ১৬০৩ শকে উত্তীর্ণ হইয়াছিল। [শিলালেখ-সংগ্রহ, পৃ. ৩-৪।] তাঁহার পরে ঠিক কতদিন তিনি রাজত্ব করেন, তাহা জানা যায় না। তবে সম্ভবত তিনি ১৬০৭ শকের পূর্বে পরলোক গমন করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর ত্রিপুরা রাজ্যে বিপর্যয় নামিয়া আসে এবং সিংহাসন লইয়া ঘোরতর দ্বন্দ্ব চলিতে থাকে। এই সময়কার ইতিহাস তমসাবৃত। রাজমালার একটি সংস্করণে এই সময়কার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাহা অত্যল্পই নহে, কিছুটা অস্পষ্টও। যতদূর বোঝা যায়, প্রথমে রামদেবের বংশীয় দ্বিতীয় রত্নমাণিক্য রাজা হন; কিন্তু অচিরেই তিনি তাঁহার খুল্লতাত-পুত্র নরেন্দ্র কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত হন। নরেন্দ্র শীঘ্রই আবার বিতাড়িত ও নিহত হইলে রত্নমাণিক্য সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন এবং কিছুদিন রাজত্ব করিয়া স্বীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহেন্দ্র কর্ত্তৃক নিহত হন। [ত্রিপুরা শিক্ষা অধিকার কর্ত্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত রাজমালার শেষ সাত পৃষ্ঠায় (৮৩২ হইতে ৮৯।২-এর মধ্যে) সংক্ষেপে এই কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে।]