যাহা হউক, ‘রাজমালা’, ‘ত্রিপুর বংশাবলী’ ও মুদ্রায় প্রাপ্ত তথ্যের সামঞ্জস্য বিধান করিয়া ধন্যমাণিক্যের রাজ্যাবসান কাল হইতে বিজয়মাণিক্যের অভিষেককাল পর্যন্ত ত্রিপুরা ইতিহাসের একটি খসড়া রচনা করা সম্ভব। মনে হয়, ১৪৩৭ শকে শেষবার চাটিগ্রাম জয়ের পরই ধন্যমাণিক্য স্বর্গারোহণ করেন। সম্ভবত ধন্যের পর অখ্যাত ধ্বজমাণিক্য ১৪৪২ শক পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং তাঁহার পর আসেন দেবমাণিক্য। তিনি ১৪৫২ শকাব্দ পর্যন্ত সিংহাসনারূঢ় থাকেন। তাঁহার হত্যার পর তাঁহার শিশুপুত্র ইন্দ্ৰমাণিক্যকে সিংহাসনে বসান হয় এবং অচিরেই এই ভাগ্যহীন রাজপুত্রকে হত্যা করিয়া তাঁহার স্থলে তাঁহার বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা প্রথম বিজয়মাণিক্যকে ১৪৫৪ শকে বা তাঁহার কিছু পূর্বে রাজা করা হয়।
কেহ কেহ মনে করেন যে, বিজয়মাণিক্য ১৪৫০ হইতে ১৪৯২ শকাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। [রাজ, ২য় পৃ. ১৮০ দ্রষ্টব্য।] এই তারিখ দুইটির কোনটিই বিজয়ের রাজত্বকালের মধ্যে পড়ে না। ১৪৫৪ শকের তাঁহার প্রাথমিক মুদ্রা হইতে প্রমাণিত হয় যে, ঐ বৎসর বা তাঁহার কিছু পূর্বে বিজয়মাণিক্য অভিষিক্ত হন এবং ১৪৮৫ ও ১৪৮৬ শকাব্দে মুদ্রিত তাঁহার ও তাঁহার পুত্র অনন্তমাণিক্যের মুদ্রাগুলি হইতে জানা যায় যে, ১৪৮৫ বা ১৪৮৬ শকে বিজয়ের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে।
যাহা হউক, বিজয়মাণিক্যের যে বহুপ্রকার মুদ্রা পাওয়া যায়, সেগুলি নানাভাব উল্লেখযোগ্য। ১৪৫৪ হইতে ১৪৮৫ শকাব্দের মধ্যে মুদ্রিত এই মুদ্রাগুলিতে তাঁহার চারটি বিচিত্র বিরূদ ও চারজন মহিষীর নাম পাওয়া যায়। চার প্রকার মুদ্রায় তাঁহাকে ‘কুমুদীশদর্শী’, ‘প্রতিসিন্ধুসীম’ ‘ত্রিপুরমহেশ’ ও ‘বিশ্বেশ্বর’ বলা হইয়াছে। এগুলির লেখনে যথাক্রমে বিজয়া, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও বাকদেবীর (বা বামাদেবীর) নাম আছে। ইঁহাদের মধ্যে রাজমালায় শুধুমাত্র লক্ষ্মীর নাম প্রত্যক্ষভাবে ও দ্বিতীয় এক রাণীর কথা পরোক্ষভাবে পাওয়া যায়। [রাজ, ২য় পৃ. ৪৩; রাজ, পৃ. ৩৬১ : “বিবাহ করিল রাজা বালা মহাদেবী। লক্ষি রহিল হিরাপুর বনবাস সেবি।”] সেনাপতি ও লক্ষ্মীর পিতা দৈত্যনারায়ণের প্রতাপে উত্ত্যক্ত হইয়া বিজয়মাণিক্য তাঁহাকে মাধব নামে এক ব্যক্তিকে দিয়া হত্যা করান। লক্ষ্মী আবার সব বৃত্তান্ত জানার পর পিতৃহন্তা মাধবকে সুকৌশলে হত্যা করান। ইহাতে বিজয় ক্রুদ্ধ হইয়া লক্ষ্মীকে নির্বাসন দেন এবং “পরে রাজা বিভা করে আর মহাদেবী।” কিন্তু পাত্রমিত্রদের অনুরোধে শেষপর্যন্ত আবার তিনি লক্ষ্মীকে গ্রহণ করেন। [রাজ, ২য় পৃ. ৪৩; রাজ, পৃ. ৩৬১।] মনে হয় এই পত্নীই বিজয়া। [বিজয়মাণিক্যের ১৪৫৪ ও ১৪৫৬ শকের প্রাথমিক দুই প্রকার মুদ্রায় এই বিজয়ার নাম আছে। পরবর্তী ১৪৫৮ শকাব্দের মুদ্রায় লক্ষ্মীর নাম পাওয়া যায়।] রাজমালায় উল্লিখিত বিজয়ের তিন প্রকার স্মারক মুদ্রাই আবিষ্কৃত হইয়াছে। [শ্রীকালীপ্রসন্ন সেন কর্ত্তৃক প্রকাশিত রাজমালায় (২য় লহর, পৃ. ৫৫) তিন প্রকার স্মারক মুদ্রার কথা থাকিলেও ত্রিপুরার শিক্ষা অধিকার কর্ত্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত রাজমালায় (পৃ. ৪১।২) ‘চারি’ প্রকার স্মারক মুদ্রার কথা আছে : (১) “ব্রহ্মপুত্রয়ী বলি মোহর মারিল”; (২) “ধ্বজঘট্টপদ পুণি (?) মোহর লিখীল; (৩) “লক্ষ্যায়ী বলি মোহর মারিয়া..”; (৪) “পদ্মাবতিস্নায়ী বলি মোহর মারিল”। প্রথম প্রকার মুদ্রা আজিও আবিস্কৃত হয় নাই।] প্রথমটি সুবর্ণগ্রাম জয়ের পর ব্রহ্মপুত্ৰতীরস্থ ধ্বজঘাট স্নানের, দ্বিতীয়টি ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী লক্ষ্যা-স্নানের এবং তৃতীয়টি পদ্মাবতী স্নানের স্মরণে মুদ্রিত হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে যে, লক্ষ্যা-স্নানের স্মারক মুদ্রাগুলিতে শিব ও দুর্গার অংশে কল্পিত অনন্যপূর্ব ‘অর্ধনারীশ্বরের মূর্ত্তি এবং পদ্মাবতী-স্নানের স্মারক মুদ্রার মুখ্যদিকে ‘শিবলিঙ্গ’ ও গৌণদিকে সিংহাসনে স্থাপিত ‘গরুড়বাহিত বিষ্ণুর মূর্ত্তি’ অঙ্কিত দেখা যায়।
প্রথম বিজয়মাণিক্য একজন শক্তিমান নৃপতি ছিলেন। সুদীর্ঘ রাজত্বকালে তিনি ত্রিপুরার শ্রীবৃদ্ধি করিয়াছিলেন। তিনি মুঘলসম্রাট আকবরের সমসাময়িক ছিলেন এবং ত্রিপুরার স্বাধীন রাজা হিসাবে আইন-ই-আকবরীতে তাঁহার উল্লেখ আছে। [রাজ, ২য় পৃ. ১১৭।] তিনি পার্শ্ববর্তী শ্রীহট্ট, জয়ন্তিয়া ও খাসিয়া রাজ্য আক্রমণ ও জয় করেন। রাজমালায় বর্ণিত তাঁহার সহিত সমসাময়িক বাংলার সুলতানদের সংঘর্ষের এবং সোনারগাঁ ও পদ্মানদী পর্যন্ত তাঁহার অভিযানের কাহিনী ইতিপূর্বেই বর্ণিত তাঁহার স্মারক মুদ্রাগুলির লেখন হইতে সমর্থিত হইয়াছে। বেশ বোঝা যায় যে তাঁহার রাজত্বের শেষের দিকে (১৪৭৯ হইতে ১৪৮৫ শকের মধ্যে) এই সব সংঘর্ষ সংঘটিত হয় এবং প্রতিক্ষেত্রেই তিনি জয়ী হইয়া স্মারক মুদ্রা নির্মাণ করেন। রাজমালায় বিশদভাবে বিজয়ের রূপ বর্ণনা করা হইয়াছে। তিনি যে চন্দ্রকান্তি গৌর পুরুষ ছিলেন, তাহা তাঁহার ১৪৫৮ শকে নির্মিত এক প্রকার মুদ্রার ‘কুমুদীশদর্শী এই বিরূদ দ্বারা সমর্থিত হইয়াছে।
বিজয়ের পর তাঁহার পুত্র অনন্তমাণিক্য ১৪৮৫ শকের শেষে বা ১৪৮৬ শকের কোন এক সময় ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন। একথা প্রমাণ করে তাঁহার ১৪৮৬ শকাব্দে মুদ্রিত গরুড়বাহিত বিষ্ণুর মূর্ত্তিসমন্বিত প্রাথমিক মুদ্রা। এই মুদ্রায় তাঁহার কোন মহিষীর নাম নাই। তাঁহার পরবর্তী মুদ্রার মুখ্যদিকে তাঁহার ও মহিষী রত্নাবতীর নাম এবং গৌণদিকে সিংহমূর্ত্তির নিম্নে ‘শক ১৪৮৭’ লেখা থাকে। রাজমালায় কিন্তু ‘অনন্তমাণিক্য-রাণী জয়া মহাদেবী’র নাম আছে। [রাজ ২য়, পৃ. ৬৭।] যাহা হউক স্বীয় শ্বশুর গোপীপ্রসাদ কর্ত্তৃক অনন্ত অচিরেই নিহত হন। এই ঘটনা ঘটে সম্ভবতঃ ১৪৮৭. শকেই, কারণ রাজমালার কাহিনী অনুযায়ী তিনি ‘বৎসর দেড়েক’ রাজ্যশাসন করিয়াছিলেন। [রাজ ২য়, পৃ. ১৮১ দ্রষ্টব্য।]