শেষপর্যন্ত তদানীন্তন বাংলার সুলতান হুসেন সাহের সহিত তাঁহার বিরোধ বাধে। রাজমালার কাহিনী হইতে বোঝা যায় যে, প্রথম দিকে ধন্য বেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন; কিন্তু পরে অলৌকিকভাবে তিনি বিপন্মুক্ত হন এবং ১৪৩৫ শকে চাটিগ্রাম জয় করিয়া স্মারক মুদ্রা নির্মাণ করেন। [রাজ, পৃ. ২২: চৌদ্দ শ পাঁচত্রিশ শাকে সমর জিনিল। চাটিগ্রাম জয় করি’ মোহর মারিল।] রাজমালায় উল্লিখিত ১৪৩৬ শকের তারিখযুক্ত ধন্যমাণিক্যের স্মারক মুদ্রার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। মনে হয়, ধন্য কর্ত্তৃক ১৪৩৫ শকের চাটিগ্রাম-বিজয় স্থায়ী হয় নাই, কারণ রাজমালায় আবার ১৪৩৭ শকে চাটিগ্রামে জয়ের কথা আছে। [রাজ, পৃ. ২৪ : চৌদ্দ শ সাত্রিশ শাকে চাটগ্রাম জিনে। শুনিয়া হোসন শাহা মহাক্রোধ মনে।]
ত্রিপুর-বংশাবলীর মতে ‘নয়শ পঁচিশ সনে’ অর্থাৎ ৯২৫ ত্রিপুরাব্দে বা ১৪৩৭ শকে ধন্যের পরলোক প্রাপ্তি ঘটে এবং অচিরেই তাঁহার পুত্র ধ্বজমাণিক্য রাজা হন ও ‘ক্রমাগত ছয় বৎসর রাজত্ব’ করিয়া ‘নয় শ একত্রিশ সনে’ বা ১৪৪৩ শকাব্দে মারা যান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রাজমালায় এই ধ্বজমাণিক্যের নামোল্লেখও নাই। সেই জন্য কেহ কেহ ধ্বজের অস্তিত্বই স্বীকার করেন না; এবং কাহারও মতে তিনি মাত্র এক বৎসর রাজত্ব করেন। [রাজ, পৃ. ১৭৮ দ্রষ্টব্য।] এই বিতর্কিত ধ্বজমাণিক্যের কোন শিলালেখ বা মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় নাই।
ধ্বজমাণিক্য যদি সত্যই রাজত্ব করিয়া থাকেন, তবে ১৪৪২ শকাব্দে বা তাঁহার কিছু পূর্বে তাঁহার রাজত্বের সমাপ্তি ঘটিয়া থাকিবে; কারণ পরবর্তী রাজা দেবমাণিক্যের ঐ বৎসরের তারিখযুক্ত একটি মুদ্রা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হইয়াছে। [আগরতলার সরকারী সংগ্রহালয়ে রক্ষিত এই মুদ্রাটি আমরা ওখানকার কিউরেটার শ্রীমতী রত্না দাসের সৌজন্যে পরীক্ষা করিতে পারিয়াছি।]
যাহা হউক, দেবমাণিক্যই ধন্যের পরবর্তী মুদ্রা নির্মাণকারী রাজা। রাজমালায় তাঁহার রাজত্বকাল সম্বন্ধে কিছুই লেখা নাই। তাঁহার সময়কার কোন শিলালিপি থাকিলেও আজিও তাহা অনাবিষ্কৃত রহিয়াছে। রাজমালার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সেন দেবমাণিক্যের কোন দ্রার কথা জানিতেন না। ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দে মুহম্মদ রেজা-উর রহিম ঢাকা মিউজিয়ামে রক্ষিত তাঁহার ১৪৪৮ শকের তারিখযুক্ত একটি সাধারণ মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছেন। [Journ. Pakistan Hist. Soc., Vol. IV. (1956)।] সম্প্রতি তাঁহার আরও দুইপ্রকার অতি মূল্যবান স্মারক মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। রাজমালায় দেবমাণিক্যকর্ত্তৃক ভুলুয়া (বা নোয়াখালি) দখল করা, ফলমতি বা চন্দ্রনাথ তীর্থে গমন করিয়া মোহর মারা (অর্থাৎ মুদ্রা নির্মাণ করা) এর দুরাশায় স্নান তর্পণ করার কথা আছে। পূর্ব্বোল্লিখিত ১৪৪২ শকে মুদ্রিত দেবমাণিক্যের প্রথম প্রকার স্মারক মুদ্রায় দেবমাণিক্যকে। ‘দুরাশার-স্নায়ী’ বলা হইয়াছে। বলা বাহুল্য, এই মুদ্রা তিনি ভুলুয়া জয় করার পর দুরাশায় স্নান করিয়া মুদ্রিত করিয়া থাকিবেন। [এই মুদ্রার মুখ্যদিকে “[দু] বাসার স্না/য়ি ত্রিপুরশ্রীশ্রীদেবমানি/ক্য পদ্মাবতৌ” চার ছত্রের এই লেখন এবং গৌণদিকে বামমুখী সিংহমূর্ত্তি ও “শক ১৪৪২”, এই তারিখ আছে।] দ্বিতীয় প্রকার যে স্মারক মুদ্রাটি দেবমাণিক্য ১৪৫০ শকে নির্মাণ করেন, তাহাতে তাহাকে ‘সুবর্ণগ্রাম বিজয়ী’ বলা হইয়াছে। [এই মুদ্রাটির মুখ্যদিকে সুবর্ণগ্রা/ম বিজয়ি/শ্রীশ্রীদেব/মাণিক্যশ্রী/পদ্মাবতৌ” পাঁচ ছত্রের এই লেখন এবং গৌণদিকে বামমুখী সিংহমূর্ত্তি ও “শক ১৪৫০” এই তারিখ আছে।] এই মুদ্রার প্রমাণ হইতে বেশ বলা যায় যে, রাজমালায় বা অন্য কোথাও উল্লিখিত না হলেও দেবমাণিক্য সাময়িকভাবে অন্তত তৎকালীন বাংলার সুলতান নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের (১৫১৯-৩২ খ্রী) নিকট হইতে সুবর্ণগ্রাম বা সোনারগাঁও জয় করিয়াছিলেন। দেবমাণিক্যের মুদ্রাগুলিতে মহিষী পদ্মাবতীর নাম পাওয়া যায়।
রাজমালার কাহিনী অনুযায়ী, দেবমাণিক্য মিথিলা নিবাসী তান্ত্রিক সন্ন্যাসী লক্ষ্মীনারায়ণ কর্ত্তৃক শ্মশান ক্ষেত্রে নিহত হন এবং তাঁহার চিতায় প্রধানা মহিষী (পদ্মাবতী?) আত্মোৎসর্গ করেন। [রাজ ২য় পৃ. ৩৬ দ্রষ্টব্য।] ‘ত্রিপুর বংশাবলী’ মতে এই ঘটনা ঘটে ৯৪৫ ত্রিপুরাব্দে বা ১৪৫৭ শকে। [রাজ ২য়, পৃ. ১৭৯, দ্রষ্টব্য।] কিন্তু ১৪৫৪ শকে নির্মিত দেবমাণিক্যপুত্র বিজয়মাণিক্যের মুদ্রা দৃষ্টে জানা যায় যে, ১৪৫৪ শকের পূর্বেই দেবমাণিক্যের রাজত্বের অবসান ঘটে। ১৪৫০ শকের তারিখ ছাড়াও ১৪৫২ শকাব্দের তারিখযুক্ত দেবমাণিক্যের সুবর্ণগ্রাম-বিজয়ের আর একটি স্মারক মুদ্রার কথা জানা যায়; এই মুদ্রাটি নকল না হইলে [আগরতলার শ্রীজহর আচার্য এই মুদ্রাটির একটি ফটোগ্রাফ দেখাইয়াছেন; তাহাতে “শক ১৪৫২” এই তারিখ আছে। কিন্তু ফটোগ্রাফ দৃষ্টে মুদ্রাটি নকল কিনা বলা কঠিন। (ত্রিপুরার মুদ্রার কিছু নকল বাজারে বাহির হইয়াছে।)] বলিতে হইবে যে, ১৪৫২ শকেও এই স্মারকমুদ্রা পুনর্মুদ্রিত হইয়াছিল এবং ঐ সময় পর্যন্ত দেবমাণিক্য সিংহাসনারূঢ় ছিলেন। রাজমালার মতে দেবমাণিক্যের হত্যার পর তাঁহার অন্য এক মহিষীর পুত্র শিশু ইন্দ্ৰমাণিক্যকে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসান হয়; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেনাপতি দৈত্যনারায়ণের ব্যবস্থায় তিনি নিহত হন এবং তাঁহার স্থলে অল্পবয়স্ক (প্রথম) বিজয়মাণিক্যকে অভিষিক্ত করা হয়। [দেবমাণিক্যের হত্যার পর চন্তাই-এর কন্যা প্রধানা মহিষী ও জ্যেষ্ঠ পুত্র বিজয়ের মাতা (পদ্মাবতী?) ‘সতী’ হন। অন্য মহিষী দেবমাণিক্যের হত্যাকারী মিথিলানিবাসী তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ লক্ষ্মীনারায়ণের সাহায্যে শিশুপুত্র (প্রথম) ইন্দ্ৰমাণিক্যকে সিংহাসনে বসান এবং বিজয়কে কারারুদ্ধ করান। কিন্তু সেনাপতি চৈতন্যনারায়ণ ইন্দ্রসহ ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যা করান।–রাজ, ২য়, পৃ. ৩৮ এবং রাজ, পৃ. ৩৩/২ ও ৩৪/১ দ্রষ্টব্য।]