১৩৮৯ শকের কতদিন পর পর্যন্ত রত্নমাণিক্য রাজত্ব করেন, তাহা বলা কঠিন। রাজমালার মতে রত্নের পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রথম প্রতাপমাণিক্য রাজা হন; কিন্তু অধার্মিক এই নৃপতিকে সেনাপতিরা নিহত করেন। প্রতাপ কতদিন সিংহাসনে বসিয়াছিলেন, তাহা বলা হয় নাই; তাঁহার কোন শিলালেখ ও মুদ্রাও মিলে নাই। প্রতাপের পর সেনাপতিরা তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা মুকুন্দ বা মুকুটমাণিক্যকে সিংহাসনে বসান। ‘রাজমালায় শুধু আছে যে বলবন্ত মুকুট
বহুদিন’ রাজ্যশাসন করেন। কিছু পূর্বে আমরা মুকুটের যে নবাবিষ্কৃত মুদ্রাটির কথা বলিয়াছি, তাঁহার বিবরণ নিম্নরূপ:
মুখ্যদিক : (লেখন) “শ্ৰীম [-] মহাদেবী শ্রীশ্রীমুকুটমাণিক্যৌ”
গৌণদিক : (চিত্রণ) গরুড়-মূর্ত্তি, (গরুড়ের চারিদিকে বৃত্তাকারে লেখন)
“নরনারায়ণে শ্রীশ্রীমুকুটমাণিক্যদেবঃ ১৪১১।” [লেখক শীঘ্রই এই মুদ্রাটি Numismatic Chronicle-এ প্রকাশ করিবেন]
১৪১১ শকের এই অনন্য ও অজ্ঞাতপূর্ব মুদ্রাটি যদি তাঁহার রাজ্যাভিষেকের সময় মুদ্রিত হইয়া থাকে, তবে বলিতে হইবে যে, তাঁহার রাজ্যকাল অতিশয় সীমিত ছিল; কারণ ১৪১১ শকের তারিখযুক্ত ধন্যমাণিক্যের মুদ্রা ঠিক পর বৎসরেই মুকুটের রাজত্বের সমাপ্তি ও ধন্যের রাজ্য-প্রাপ্তির কথা ঘোষণা করে।
ধন্যের ১৪১২ শকের মুদ্রা ছাড়াও আরও কতকগুলি তারিখবিহীন মুদ্রার [R.D. Banerji, In. Rep. Arch. Surv. Ind., 1913-14] প্রমাণ দৃষ্টে মনে হয় যে, ঐ তারিখেরও কিছু পূর্বে ধন্য সিংহাসনে বসেন এবং ঐসব মুদ্রা নির্মিত করেন। আবার রাজমালার কাহিনী অনুযায়ী, ধন্যের পূর্বে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় প্রতাপমাণিক্য রাজা হন, কিন্তু “অধার্মিক দেখি তারে লোকে মারে পরে”। এই দ্বিতীয় প্রতাপের কাহিনী নিতান্তই কাল্পনিক ও ভ্রমাত্মক। যতদূর মনে হয়, রত্নমাণিক্যের মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন ঐশ্বর্যলোভী, শক্তিশালী ও কুচক্রী সেনাপতিদের খেলা চলে, এবং তাহারা যাহাকে ও যখন খুশী সিংহাসনে বসায় ও সিংহাসনচ্যুত করে। এই ভাবে পর পর তথাকথিত ‘প্রথম’ প্রতাপ ও মুকুট রাজা হন; কিন্তু তাহাদের রাজত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। মুকুটমাণিক্য ও ধন্যমাণিক্যের মধ্যে সম্ভবত কোন প্রতাপের অস্তিত্ব ছিল না।
যাহা হউক, ত্রিপুরার তৃতীয় মুদ্রা নির্মাণকারী রাজা ধন্যমাণিক্যের মুদ্রা সব দিক দিয়া–অর্থাৎ আকৃতিতে, প্রকৃতিতে, চিত্রণে, লেখনে ও অক্ষর বিন্যাসে–রত্নমাণিক্যের সিংহমূর্ত্তি-সমম্বিত মুদ্রাগুলির অনুরূপ। [বিশেষ করিয়া রত্ন ও ধন্যের প্রাথমিক মুদ্রা পাশাপাশি রাখিয়া তুলনা করিলেই একথা স্পষ্ট হইবে; মনে হইবে যেন একই শিল্পীর হাতে উভয়ের মুদ্রা নির্মিত হইয়াছে।] ধন্যও তাঁহার প্রাথমিক মুদ্রায় তারিখ ও মহিষীর নাম লেখেন নাই। তাঁহারও (সম্প্রতি প্রাপ্ত) এক প্রকার মুদ্রার গৌণদিকে বৃত্তাকারে একটি লেখন-ছত্র উৎকীর্ণ আছে। এই লেখনটিতে “অরবিংদ-চরণপরায়ণ [ঃ] শুভমস্তু [শকে ১৪১২” ] লেখা আছে। [এই মুদ্রাটি বিখ্যাত সংগ্রাহক শ্ৰী জি.এস. বিদের সংগ্রহে আছে। তাঁহারই সৌজন্যে ও শ্রী পি.কে. উরির আনুকূল্যে আমরা এই মুদ্রাটি পরীক্ষা করিতে পারিয়াছি।] এই ১৪১২ শকেই মুদ্রিত ধন্যের অন্য প্রকার কতকগুলি মুদ্রায় তাঁহার বিরূদ হিসাবে ‘ত্রিপুরেন্দ্র’ কথাটি ও মহিষী ‘কমলা’র নাম পাওয়া যায়। ১৪২৮ শকের মুদ্রাগুলি পূর্ব্বোক্ত মুদ্রার প্রায় অনুরূপ হইলেও সেগুলিতে বিরূদ হিসাবে ‘বিজয়ীন্দ্র’ কথাটি লেখা থাকে। তাঁহার শেষ মুদ্রাগুলি ১৪৩৬ শকাব্দে (রাজমালার কথা মতই) ‘চাটিগ্রাম-বিজয়ের স্মারক মুদ্রা হিসাবে মুদ্রিত হইয়াছিল। মুখ্যাদিকে ইহাদের যে লেখন আছে, তাহা এইরূপ : “চাটিগ্রাম-বিজয়ি শ্রীশ্রীধন্যমাণিক্য শ্রীকমলাদেব্যৌ”।
রাজমালার মতে ধন্য বালকবয়সে রাজা হন এবং তিপ্পান্ন বৎসর রাজত্ব করিয়া নয় শ পঁচিশ সনে’ অর্থাৎ ত্রিপুরাব্দে (বা ১৪৩৭ শকে ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দে) পরলোক গমন করেন। তিপ্পান্ন বৎসর ধন্য নিশ্চয়ই রাজত্ব করেন নাই। কারণ আমরা ইতিপূর্বে দেখিয়াছি ধন্য ১৪১১-১২ শকে সিংহাসনে বসেন। এখন, তাঁহার মৃত্যু যদি ১৪৩৭ শকাব্দে হয়, তাহা হইলে তাঁহার রাজ্যকাল ২৬ বছরের বেশি হইতে পারে না। সম্ভবত তিপ্পান্ন বৎসর রাজত্ব করিয়া নহে, তিপ্পান্ন বৎসর বয়সে’ ধন্যমাণিক্য মারা যান। যাহা হউক, ত্রিপুরার ইতিহাসে ধন্যের সুদীর্ঘ ও ঘটনাবহুল শাসন বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য।
অতি অল্প বয়সে রাজা হইয়া ধন্যমাণিক্য চক্রান্তকারী সেনাপতিদের সম্বন্ধে সন্ত্রস্ত হইয়া পড়েন ও নিতান্তই অসহায় বোধ করেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য ছলনার আশ্রয় লইয়া তাহাদের বিনাশ করেন ও রাহুমুক্ত হন। [রাজ, ২য়, পৃ. ১৪-১৫।] শীঘ্রই তিনি বড় সেনাপতির কন্যা কমলাকে বিবাহ করিয়া নিশ্চিন্তে রাজকার্যে মনোনিবেশ করেন।
ধন্যমাণিক্যের আমলে ত্রিপুরারাজ্য বিশেষ সমৃদ্ধ হইয়া উঠে। তিনি মন্দির নির্মাণ, পুষ্করিণী খনন প্রভৃতি বহু পুণ্য ও জনহিতকর কার্য করিয়া সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। অপরপক্ষে তিনি ত্রিপুরার পূর্বদিকস্থ কুকিদের পার্ব্বত্য অঞ্চল আক্রমণ করিয়া তাহা নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। বলা বাহুল্য, পার্শ্ববর্তী রাজ্যজয়ে উৎসাহিত হইয়াই, ১৪২৮ শকে নির্মিত এক প্রকার মুদ্রায় স্বীয় নামের পূর্বে ‘বিজয়ীন্দ্র’ এই উপাধি লেখেন।