রাজমালায় ছেংগুমের প্রপৌত্র ডাঙ্গরফার কথা আছে। সম্ভবত তিনি ছেংগুমের পুত্র ছিলেন, প্রপৌত্র নহেন। আমাদের বিশ্বাস, ত্রিপুরার এই দ্বিতীয় বিশিষ্ট রাজা ডাঙ্গরফারই হিন্দু নাম ধর্মমাণিক্য। [রাজমালা অনুযায়ী ডাঙ্গরফা রত্নের ঠিক অব্যবহিত পূর্বে রাজত্ব করেন। তাম্রলেখ ও মুদ্রার প্রমাণ হইতে দেখা যায় যে, রমাণিক্যের ঠিক পূর্বেই ছিলেন ধর্মমাণিক্য। ডাঙ্গরফা ও ধর্মমাণিক্য অভিন্ন হওয়াই সম্ভব।] দ্বিজ বঙ্গচন্দ্রের ত্রিপুরবংশাবলী অনুযায়ী মহারাজ ধর্মমাণিক্য ৮৪১ হইতে ৮৭২ ত্রিপুরাব্দ (অর্থাৎ ১৩৫৩-৮৪ শকাব্দ বা ১৪৩১-৬২ খ্রীষ্টাব্দ) পর্যন্ত ৩২ বৎসর রাজত্ব করেন। [রাজ, ১ম, পৃ. ৮১-৮২।] একথা সত্য হওয়া সম্ভব; কারণ রাজমালার মতেও ধর্মমাণিক্য ‘বত্রিশ বৎসর রাজ্যভোগ’ করেন [রাজ, ২য়, পৃ. ৮ : ‘বত্রিশ বৎসর রাজা রাজ্য ভোগ ছিল’] এবং (বঙ্গচন্দ্রের দেওয়া সময়ের মধ্যেই) ১৩৮০ শকে ধর্মসাগর উৎসর্গোপলক্ষে একখানি তাম্রশাসন দ্বারা ব্রাহ্মণদের ভূমি দান করেন। [রাজ, ২য়, পৃ. ৫ এবং পাদটীকা।]
যাহা হউক, আমাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেখা যায় যে, ১৪৩১ খ্রীষ্টাব্দে ধর্মমাণিক্য বা ডাঙ্গরফার সিংহাসনারোহণের কিছু পূর্বে গৌড়ের কোন দুর্বল সুলতানের আমলে–অর্থাৎ যে সময় দনুজমর্দন বা রাজা গণেশ সাময়িকভাবে গৌড়ের কর্তৃত্ব আয়ত্তে আনেন সেই সময় ছেংগুম্ফা বা মহামাণিক্য পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টের মধ্যবর্তী বিস্তৃত ভূভাগ জয় করিয়া নূতন একটি রজ্যের পত্তন করেন। [এ পর্যন্ত রত্নমাণিক্যের মুদ্রার তারিখটি ঠিকমত না পড়িতে পারায় রত্নের রাজ্যকাল সম্বন্ধে যে ভুল ধারণা ছিল, তাঁহারই পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্ভাব্য অবস্থাটি আমরা ধরিতে পারি নাই। এই গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
ধর্মমাণিক্যের ঠিক পরেই ত্রিপুরায় রাজত্ব করেন সম্ভবত তাঁহার পুত্র রত্ন-ফা বা রত্নমাণিক্য। রত্ন ১৩৮৬ শকে প্রথম তারিখযুক্ত মুদ্রা প্রচলন করিলেও ঐ সময়ের অন্তত ২। ৩ বৎসর পূর্বেই যে সিংহাসনে বসেন, তকতৃক মুদ্রিত কয়েক প্রকার তারিখহীন মুদ্রাই তাঁহার সাক্ষ্য দেয়। [এই মুদ্রাগুলি প্রধানত চতুর্বিধ : (১) উভয় পার্শ্বে লেখনযুক্ত মুদ্রা–(মুখ্যদিকে) শ্রীনারায়ণচরণপরঃ (গৌণদিকে) শ্রীশ্রীরত্বমাণিক্যদেবঃ’; (২) (মুখ্যদিকে) শ্রীশ্রীরমাণিক্যদেবঃ (গৌণদিকে) সিংহমূর্ত্তি ও তাঁহার নীচে শ্রীদুর্গা’; (৩) (মুখ্যদিকে) শ্রীনারায়ণচরণপরঃ শ্রীশ্রীরঙ্গমাণিক্যদেবঃ’ (গৌণদিকে) সিংহমুর্তি ও তাঁহার নীচে শ্রীদুর্গা; (৪) মুখ্যদিকে লেখন দ্বিতীয় প্রকার মুদ্রার মত, কিন্তু গৌণদিকে শুধু সিংহের অবয়ব (outline)) আছে।] এই ভাবে দেখা যায় যে, ঠিক বঙ্গচন্দ্রের বর্ণনানুযায়ী ১৩৮৪ শকাব্দে ধর্মমাণিক্য বা ডাঙ্গরফার মৃত্যু হয় এবং অচিরেই রত্ন ত্রিপুরা-সিংহাসনে বসেন।
রাজমালার কাহিনী অনুযায়ী ডাঙ্গরফার অষ্টাদশতম পুত্র ছিলেন রত্ন-ফা। বেশ কিছুদিন তদানীন্তন বাংলার সুলতানের দরবারে থাকিয়া তাঁহারই সাহায্যে রত্ন পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের পরাজিত করিয়া ত্রিপুরার সিংহাসন লাভ করেন। কথিত আছে, রত্ন কর্ত্তৃক একটি মহামূল্য ‘মাণিক’ উপহার পাইয়া গৌড়েশ্বর তাঁহাকে ত্রিপুরারাজগণের পরিচয়সূচক ‘মাণিক্য’ উপাধিতে ভূষিত করেন। [আমরা আগেই দেখিয়াছি ইহা কিংবদন্তীমাত্র; সম্ভবত এই কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই। বাংলা ‘রাজমালায় মাণিক্য’ উপাধি প্রদানকারীকে ‘গৌড়েশ্বর’ বলা হইয়াছে (রাজ, ১ম, পৃ. ৬৭); সংস্কৃত ‘রাজমালায় ইহাকে দিল্লীশ্বররূপে উল্লেখ করা হইয়াছে (ঐ, পৃ. ১৫৯)।] রত্নমাণিক্য একজন মহাপ্রতাপশালী রাজা ছিলেন। [রাজ, ১ম, পৃ. ৬৮-৬৯।] বর্তমানে রত্নের যে বহু প্রকার মুদ্রা পাওয়া যায়, সেগুলিতে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষারই ছাপ নাই, সেগুলি ত্রিপুরার প্রাথমিক মুদ্রা হিসাবে বিচিত্র ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহার মুদ্রাগুলি হইতে বেশ বোঝা যায় যে, সগ্রামশীল বিজয়ী একটি উপজাতির অধীশ্বর রত্ন-ফা শাক্তদেবী দুর্গা ও নারায়ণ (বা বিষ্ণুর) প্রতি অনুরক্ত হইয়া উঠেন। তিনি প্রাথমিক একপ্রকার তারিখ ও চিত্রণহীন মুদ্রায় স্বীয় বিরূদ হিসাবে ‘শ্রীনারায়ণ-চরণপরঃ’ এই কথা লেখেন। পরবর্তী তারিখহীন মুদ্রাগুলির একদিকে রত্নমাণিক্য নিজের নাম ও অপরদিকে দুর্গার বাহন সিংহের মূর্ত্তি ও ‘শ্রীদুর্গা’ এই লেখন অঙ্কিত করেন। ১৩৮৬ ও ১৩৮৮ শকের মুদ্রাগুলিতে দুর্গা ও বিষ্ণু উভয়ের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। সিংহমূর্ত্তি সমন্বিত এই সব মুদ্রার গৌণদিকের লেখন-ছত্রে কখন ‘শ্রীদুর্গাপদপরঃ’, কখনও বা ‘শ্রীদুর্গারাধনাপ্তবিজয়ঃ’, [আমাদের পাওয়া রমাণিকের মুদ্রার প্রান্তিক লেখনের এই অংশটি কাটিয়া যাওয়ায় আমরা ইহাকে শ্রীদুর্গারাধমাপুবিজয়ঃ পড়িয়াছিলাম। ত্রিপুরা মিউজিয়ামে রক্ষিত পরিপূর্ণভাবে মুদ্রিত একটি মুদ্রা হইতে অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার এই অংশটিকে ‘শ্রীদুর্গারাধনাপ্তবিজয়ঃ’ পড়িয়াছেন : বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১০ম বর্ষ] আবার কখনও ‘শ্রীনারায়ণচরণপরঃ’ [ইতিপূর্বে একটি মুদ্রায় শ্রীদুর্গাপদপরঃ এই বিরূদ পড়া হইয়াছে : বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১০ম বর্ষ। যে মুদ্রায় শ্রীনারায়ণচরণপরঃ এই বিরূদ আছে, তাহা শীঘ্রই বর্তমান লেখক প্রকাশ করিবেন] এই বিরূদ ও টাকশালের নাম হিসাবে ‘রত্নপুরে’ [রত্নপুর নিঃসন্দেহে রমাণিক্যের রাজধানী ছিল (রাজ, ১ম, পৃ. ৬৯)। সেখানে তাঁহার টাকশালও ছিল। রত্নমাণিক্যের পর আর কোন ত্রিপুরারাজের মুদ্রার টাকশালের নাম নাই] এই কথা লেখা থাকে। রত্নের ১৩৮৯ শকের মুদ্রা সিংহমূর্ত্তি বিহীন, কিন্তু বিচিত্র লেখনযুক্ত। [বর্তমান লেখক বাংলা দেশের ইতিহাস মধ্যযুগ, প্রথম সংস্করণে সর্বপ্রথম এই মুদ্রাটি প্রকাশ করেন।] ইহার মুখ্য ও গৌণদিকে যথাক্রমে ‘পার্ব্বতী-পরমেশ্বর-চরণপরৌ’ এবং শ্রীলক্ষ্মীমহাদেবী শ্রীশ্রীরত্বমাণিক্যৌ’, লেখা থাকে। এই মুদ্রা ‘রাজমালায় অনুল্লিখিত রত্নের মহিষী লক্ষ্মীর নামই শুধু ঘোষাণা করিতেছে না, তাহাকে রত্নের নামেরও পূর্বে স্থান দিতেছে।