এই সমস্ত কথা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নহে। ফিরোজ শাহ যে এই সমস্ত কারণের জন্য একডালা দুর্গ অধিকারে বিরত হন নাই, তাঁহার প্রমাণ–ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পরে তিনি আর একবার বাংলা দেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন ও একডালা দুর্গ জয়ের চেষ্টা করিয়াছিলেন। মোটের উপর ইহাই সত্য বলিয়া মনে হয় যে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ অধিকার করিতে পারেন নাই বলিয়াই করেন নাই। যুদ্ধের ফিরোজ শাহের কোন ক্ষতি হয় নাই-বারনির এই কথাও সত্য বলিয়া মনে হয় না। আফিফ লিখিয়াছেন যে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হইয়াছিল এবং পরবর্তী গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-মুবারক শাহী’তে তাঁহার উক্তির সমর্থন পাওয়া যায়।
আসল কথা, ফিরোজ শাহ ও ইলিয়াস শাহের যুদ্ধে কোন পক্ষই চূড়ান্তভাবে জয়ী হইতে পারে নাই। ফিরোজ শাহ যুদ্ধের ফলে শেষপর্যন্ত কয়েকজন বন্দী, কিছু লুঠের মাল এবং কয়েকটি হাতি ভিন্ন আর কিছুই লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহার পক্ষেও নিশ্চয়ই কিছু ক্ষতি হইয়াছিল, যাহা তাঁহার অনুগত ঐতিহাসিকরা গোপন করিয়া গিয়াছেন। ইলিয়াস যুদ্ধের আগেও একডালা দুর্গে ছিলেন, এখনও সেখানেই রহিয়া গেলেন। সুতরাং কার্যত তাঁহার কোন ক্ষতিই হয় নাই। ফিরোজ শাহ যে কেন পশ্চাদপসরণ করিলেন, তাহাও স্পষ্টই বোঝা যায়। বারনি ও আফিফ লিখিয়াছেন যে, যে সময় ফিরোজ শাহ একডালা অবরোধ করিয়াছিলেন, তখন বর্ষাকাল আসিতে বেশি দেরি ছিল না। বর্ষাকাল আসিলে চারিদিক জলে প্লাবিত হইবে, ফলে ফিরোজ শাহের বাহিনী বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে, মশার কামড়ে ঘোড়াগুলি অস্থির হইবে এবং তখন ইলিয়াস অনায়াসেই জয়লাভ করিবেন, এই সব ভাবিয়া ফিরোজ শাহ অত্যন্ত বিচলিত বোধ করিতেছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, ফিরোজ শাহের আক্রমণের সময় ইলিয়াস প্রথমেই সম্মুখযুদ্ধ না করিয়া কৌশলপূর্ণ পশ্চাদপসরণ করিয়াছিলেন, ফিরোজ শাহকে দেশের মধ্যে অনেক দূর আসিতে দিয়াছিলেন এবং নিজে একডালার দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় লইয়া বর্ষার প্রতীক্ষায় কালহরণ করিতেছিলেন। ফিরোজ শাহ ইলিয়াসের সঙ্গে একদিনের যুদ্ধে কোনরকমে নিজের মান বাঁচাইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি এই যুদ্ধে ইলিয়াসের শক্তিরও পরিচয় পাইয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন যে ইলিয়াসকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইবে না। উপরন্তু বর্ষাকাল আসিয়া গেলে তিনি ইলিয়াস শাহের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হইবেন। সেইজন্য, ইলিয়াসের হাতি জয় করিয়া তাঁহার দর্প চূর্ণ করিয়াছি, এই জাতীয় কথা বলিয়া ফিরোজ শাহ আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছিলেন এবং মানে মানে বাংলা দেশ হইতে প্রস্থান করিয়াছিলেন।
ফিরোজ শাহ একডালার নাম বদলাইয়া ‘আজাদপুর’ রাখিয়াছিলেন। দিল্লিতে পৌঁছিয়া ফিরোজ শাহ ধুমধাম করিয়া ‘বিজয়-উৎসব’ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। কিন্তু বাংলা দেশ হইতে তাঁহার বিদায়গ্রহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইলিয়াস তাঁহার অধিকৃত বাংলার অঞ্চলগুলি পুনরধিকার করিয়া লইয়াছিলেন। শেষপর্যন্ত এই দুই সুলতানের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। সন্ধির ফলে ফিরোজ শাহ ইলিয়াস শাহের স্বাধীনতা কার্যত স্বীকার করিয়া লন। ইহার পরে দুই রাজা নিয়মিতভাবে পরস্পরের কাছে উপঢৌকন প্রেরণ করিতেন।
একডালার যুদ্ধে ইলিয়াস শাহের সৈন্যদের মধ্যে সর্বপেক্ষা বেশি বীরত্ব প্রদর্শন করে তাঁহার বাঙালী পাইক অর্থাৎ পদাতিক সৈন্যেরা। পাইকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল হিন্দু। পাইকদের দলপতি সহদেব এই যুদ্ধে প্রাণ দেন।
এই একডালা কোন্ স্থানে বর্তমান ছিল, সে সম্বন্ধে এতদিন কিছু মতভেদ ছিল। তবে বর্তমানে এ সম্বন্ধে যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে নিঃসংশয়ে বলা যায় যে গৌড় নগরের পাশে গঙ্গাতীরে একডালা অবস্থিত ছিল। [*এ সম্বন্ধে লেখকের বিস্তৃত আলোচনা—’বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর’ গ্রন্থের (২য় সং)। অষ্টম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
ইলিয়াস শাহ সম্বন্ধে প্রামাণিকভাবে আর বিশেষ কোন তথ্যই জানা যায় না। তিনি যে দৃঢ়চেতা ও অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তাহা ফিরোজ শাহের আক্রমণ প্রতিরোধ এবং পরিণামে সাফল্য অর্জন হইতেই বুঝা যায়। মুসলিম সাধুসন্তদের প্রতি তাঁহার বিশেষ ভক্তি ছিল। তাঁহার সময়ে বাংলা দেশে তিনজন। বিশিষ্ট মুসলিম সন্ত বর্তমানে ছিলেন–অখী সিরাজুদ্দীন, তাঁহার শিষ্য আলা অল হক এবং রাজা বিয়াবানি। কথিত আছে, ফিরোজ শাহের একডালা দুর্গ অবরোধের সময় রাজা বিয়াবানির মৃত্যু হয় এবং ইলিয়াস শাহ অসীম বিপদের ঝুঁকি লইয়া ফকীরের ছদ্মবেশে দুর্গ হইতে বাহির হইয়া তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিয়াছিলেন, দুর্গে ফিরিবার আগে ইলিয়াস ফিরোজ শাহের সহিত দেখা করিয়া কথাবার্তা বলিয়াছিলেন, কিন্তু ফিরোজ শাহ তাঁহাকে চিনিতে পারেন নাই এবং পরে সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়া তাঁহাকে বন্দী করার এত বড় সুযোগ হারানোর জন্য অনুতাপ করিয়াছিলেন।
অধিকাংশ ইতিহাসগ্রন্থের মতে ইলিয়াস শাহ ভা বা সিদ্ধির নেশা করিতেন। ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’র মতে ইলিয়াস কুষ্ঠরোগী ছিলেন। কিন্তু ইহা ইলিয়াসের শত্রুপক্ষের লোকের বিদ্বেষপ্রণোদিত মিথ্যা উক্তি বলিয়া মনে হয়।