ত্রিপুরার রাজাদের মধ্যে রত্ন-ফা বা রত্নমাণিক্যই প্রথম মুদ্রা নির্মাণ করেন। ‘রাজমালার তালিকা অনুযায়ী এই প্রথম রত্নমাণিক্য হইতে দ্বিতীয় ইন্দ্ৰমাণিক্য পর্যন্ত যে আটাশ জন রাজা অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ত্রিপুরায় রাজত্ব করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অন্তত একুশ জনের [এই পরিশিষ্টের শেষভাগে রাজগণের তালিকা দ্রষ্টব্য] মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। এই মুদ্রাগুলি অধিকাংশই ‘সাধারণ’ মুদ্রা হিসাবে নির্মিত হইলেও ইহাদের মধ্যে অন্তত কতকগুলি ‘স্মারক মুদ্রা হিসাবে মুদ্রিত হইয়াছিল। রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে ও পরবর্তী কোন কোন সময় সাধারণ মুদ্রা নির্মিত হইত। রাজ্যজয়, তীর্থস্নান, তীর্থদর্শন প্রভৃতি বিশেষ ঘটনার স্মরণার্থে ‘স্মারক মুদ্রা মুদ্রিত হয়। কাছাড়রাজ ইন্দ্রপ্রতাপনারায়ণের ১৫২৪ শকে নির্মিত শ্রীহট্টবিজয়ের’ এবং হুসেন শাহের ‘কামরু, কামতা, জাজনগর ও ওড়িষা জয়ের’ বিখ্যাত স্মারক মুদ্রাগুলি ছাড়া ত্রিপুরা রাজাদের মত স্মারক মুদ্রা প্রচারের আর বিশেষ সমসাময়িক নজির নাই। [ইন্দ্রপ্রতাপনারায়ণের মুদ্রাটি লেখক কর্ত্তৃক Numismatic Chronicle–এ প্রকাশিত হইবে]
ত্রিপুরার মুদ্রাগুলি প্রধানত রৌপ্যনির্মিত, ছাঁচে-পেটা (die struck) ও গোলাকার। এগুলি তকালীন বাংলার সুলতানদের ‘তখা’ (টঙ্ক বা টাকা) নামক মুদ্রার অনুকরণে আনুমানিক ১৭২ গ্ৰেণ (বা ১১.১৫ গ্রাম) ওজনে তৈরী হইত। এগুলি পাঁচ প্রকারের : পূর্ণ, অর্ধ, এক-চতুর্থ, এক-অষ্টম ও এক-ষোড়শ। আলোচ্য সময়ে ত্রিপুরারাজ প্রথম (?) বিজয়মাণিক্যের একটিমাত্র পূর্ণ আকারের স্বর্ণ মুদ্রার কথা জানা যায়। [JRASB, 1910] ত্রিপুরার কোন তাম্র মুদ্রা পাওয়া যায় নাই। ছোটখাট কেনাবেচার কাজ সম্ভবত কড়ি দিয়াই চলিত।
দ্বিতীয় ইন্দ্ৰমাণিক্য ছাড়া আর সব মুদ্রা নির্মাণকারী রাজার রৌপ্য নির্মিত পূর্ণ টঙ্ক পাওয়া গিয়াছে। এই ইন্দ্ৰমাণিক্য ও কৃষ্ণমাণিক্যের কয়েকটি অতিবিরল অর্ধ টঙ্ক আবিষ্কৃত হইয়াছে। যশোধরমাণিক্য, গোবিন্দমাণিক্য, রামদেবমাণিক্য, দ্বিতীয় রমাণিক্য, দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্য ও দ্বিতীয় ইন্দ্ৰমাণিক্যের এক-চতুর্থ টঙ্কের কথা আমরা অবগত আছি। এছাড়াও গোবিন্দের কয়েকটি এক-অষ্টম ও দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্যের একটি এক-ষোড়শ মুদ্রাও পাওয়া গিয়াছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যযুগের মুদ্রাগুলির মধ্যে ত্রিপুরা মুদ্রার স্থান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঐ সময়ে একমাত্র ত্রিপুরা মুদ্রাতেই চিত্রণ (device) দেখা যায় এবং ভারতীয় মুদ্রাগুলির মধ্যে শুধু এগুলিতেই রাজার নামের সহিত প্রায় নিয়মিত ভাবেই রাজমহিষীর নামও থাকে।
ত্রিপুরা মুদ্রার মুখ্যদিকে (obverse) শুধু লেখন (legend or inscription) থাকে এবং তাহা সংস্কৃত ভাষায় ও বাংলা অক্ষরে লিখিত। এই লেখনের প্রথমাংশে রাজার বিরূদ (epithet) এবং দ্বিতীয়াংশে রাজা ও রাণীর, অথবা শুধু রাজার নাম দেখা যায়। যথা–”ত্রিপুরেন্দ্র শ্রীশ্রীধন্যমাণিক্য শ্রীকমলাদেব্যৌ” অথবা “শ্রীনারায়ণ-চরণপরঃ শ্রীশ্রীরমাণিক্যদেবঃ”। ত্রিপুরা মুদ্রার গৌণদিকে (reverse) সাধারণতঃ ‘পৃষ্ঠে ধ্বজবাহী সিংহের মূর্ত্তি’ ও শকাব্দে তারিখ থাকে। ক্ষুদ্রাকৃতি মুদ্রায় স্থানাভাবে রাজার বিরূদ, রাজ-মহিষীর নাম, তারিখ ও কখন কখন রাজার নামে ‘মাণিক্য অংশটি দেখা যায় না। এক-চতুর্থ মুদ্রাগুলিতে কিন্তু তারিখ থাকেই। [জয়ন্তীপুর ও আহোম রাজাদের এক-চতুর্থ মুদ্রাগুলিতেও তারিখ থাকেই।]
ত্রিপুরার প্রথম মুদ্রা নির্মাণকারী রাজা রত্নমাণিক্য বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ত্রিপুরা মুদ্রার বিশিষ্ট রূপটির প্রবর্তন করেন। তাঁহার প্রাথমিক মুদ্রায় উভয় দিকেই তৎকালীন মুসলমান সুলতানদের মুদ্রার মতই শুধুই লেখন থাকে। পরে তিনি গৌণ দিকে ত্রিপুরা মুদ্রার পরিচায়ক সিংহের মূর্ত্তিটি অঙ্কিত করেন। তাঁহারও পরে সুলতানদের মুদ্রার মতই গৌণ দিকে একটি বৃত্তাকার প্রান্তিক লেখনে (circular marginal legend) টাকশালের নাম ও তারিখ লেখা হয়। রত্নের শেষ প্রকারের মুদ্রার লেখনে তাঁহার নামের সহিত মহিষীর নামও থাকে। শেষপর্যন্ত গৌণ দিকের লেখন-ছত্রের বিলোপ ঘটে [রত্নের পরে মুকুট ও ধন্যের কয়েকটি মাত্র প্রান্তিক লেখনযুক্ত মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে] এবং তাঁহার পরিবর্তে চিত্রণের নীচে শুধু শকাব্দে তারিখ লেখা হয়।
নিম্নলিখিত চারজন রাজার মাত্র পাঁচ প্রকার মুদ্রায় ত্রিপুরা মুদ্রার বিশিষ্ট সিংহমূর্ত্তির পরিবর্তে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিচিত্র কয়েকটি চিত্রণ দেখা যায় :
লণ্ডনের একটি সংগ্রহে মুকুটমাণিক্যের ১৪১১ শকের একটি মুদ্রায় ‘সিংহের’ পরিবর্তে ‘গরুড়ের’ মূর্ত্তি আছে। [এই অনন্য মুদ্রাটি শীঘ্রই লেখক কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইবে]
বিজয়মাণিক্যের ১৪৮০, ১৪৮১, ১৪৮২ শকে মুদ্রিত ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী লক্ষ্যায় স্নানের এক প্রকার স্মারক মুদ্রার গৌণদিকে বৃষবাহন চতুর্ভুজ শিব ও সিংহবাহিনী দশভুজা দুর্গার অর্ধাংশ দিয়া গড়া একটি অনন্য ‘অর্ধনারীশ্বর’ মূর্ত্তি দেখা যায়। [বর্তমান লেখকই প্রথমে এই মুদ্রার চিত্রণটিকে অর্ধনারীশ্বর’ বলিয়া প্রতিপন্ন করেন। পূর্বে ইহাকে মহিষমর্দিনী মূর্ত্তি’ বলা হইত : (১) শ্রীকালীপ্রসন্ন সেন, ‘রাজমালা, ২য়, এবং (২) শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র বর্ম্মণ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯শে পৌষ, ১৩৫৪ সাল, পৃ. ৯, ১১-১২।] এই বিজয়েরই ১৪৮৫ শকের পদ্মা-স্নানের আর এক প্রকার স্মারক মুদ্রায় ‘গরুড়-বাহিত বিষ্ণুর মূর্ত্তি’ আছে; এই বিষ্ণুর দক্ষিণে ও বামে যথাক্রমে একটি পুরুষ ও একটি নারীর দণ্ডায়মান মূর্ত্তি, এবং সমগ্র চিত্রণটি ‘প্রতিকোণে’ দুইটি করিয়া সিংহ-বাহিত চতুষ্কোণ একটি সিংহাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। [ইহা বর্তমানে লেখক প্রকাশ করিয়াছেন : Journ, Anc. Ind. Hist. Vol. III:p. 25, pl. XII, 3-4] এই একই প্রকার মুদ্রার মুখ্যদিকের লেখনের মধ্যভাগের একটি চতুষ্কোণের ভিতর ‘শিবলিঙ্গ’ থাকে।