প্রাণনারায়ণের পরবর্তী রাজাদের অর্ধ মুদ্রাগুলি বেশ একটু বিচিত্র ধরনের : পূর্ণ আকারের বৃহত্তর টঙ্কের ঘঁচ দিয়া ক্ষুদ্রতর আকারের অর্ধ টঙ্ক মুদ্রিত হওয়ায় তাহাদের উভয় পার্শ্বের লেখন শুধু আংশিকভাবে দৃষ্ট হয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজার নাম পড়া প্রায় দুঃসাধ্য হইয়া পড়ে। যাহা হউক, কোচ রাজাদের নামের শেষাংশ ‘নারায়ণ’ হইতেই এই জনপ্রিয় মুদ্রাগুলির নাম নারায়ণী মুদ্রা হইয়াছে। পরবর্তীকালে কোচবিহারের উত্তরস্থ ভুটান রাজ্যে কোচবিহারের অর্ধ মুদ্রা বিস্তৃতভাবে অনুকৃত ও প্রচলিত হয়।
নরনারায়ণের মুদ্রাগুলি বাংলা অক্ষরে লিখিত হইলেও আকৃতি ও প্রকৃতিতে সেগুলি হুসেনশাহী তখারই অনুরূপ। ইহাদের মুখ্যদিকে ‘শ্রীশ্রীশিবচরণ কমলমধুকরস্য’ ও গৌণদিকে ‘শ্রীশ্রীমন্নরনারায়ণস্য’ বা ‘নারায়ণ ভুপালস্য শাকে ১৪৭৭’, এই লেখন থাকে। নরনারায়ণের জ্যেষ্ঠ পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণের মুদ্রার মুখ্য দিকে নরনারায়ণের মুদ্রার মতই “শ্রীশ্রীশিবচরণ কমলমধুকরস্য” লেখা থাকে এবং গৌণ দিকে থাকে “শ্রীশ্রীমল্লক্ষ্মীনারায়ণস্য শাকে ১৫০৯ ও ১৫৪৯ বা ১৫৫৯”। লক্ষ্মীনারায়ণের পরে তাঁহার পৌত্র প্রাণনারায়ণের পূর্ণ ও অর্ধ মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। সেগুলির মুখ্যদিকের লেখন (বা রাজার বিরূদ) পূর্ববৎ গৌণ দিকে শ্রীশ্রীমপ্রাণনারায়ণস্য শাকে ১৫৫৪, ১৫৫৫ বা ১৫৫৯ লিখিত থাকে। বৃটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত তাঁহার একটি মুদ্রায় শকাব্দের পরিবর্তে কোচবিহারের ‘রাজশকের’ তারিখ হিসাবে ‘শাকে ১৪০’ (= ১৬৪৯ খ্রীষ্টাব্দ) লেখা দেখা যায়। প্রাণনারায়ণের পুত্র মোদনারায়ণের ১৭৯ (?) রাজশকের তারিখ ও অসম্পূর্ণ লেখন সম্বলিত অর্ধ টঙ্ক পাওয়া গিয়াছে। তাঁহার পর (আমাদের আলোচ্য সময়ে) বাসুদেবনারায়ণ, রূপনারায়ণ ও উপেন্দ্রনারায়ণের তারিখবিহীন ও অসম্পূর্ণ লেখন সম্বলিত মামুলী অর্ধ টঙ্ক পাওয়া গিয়াছে; শুধুমাত্র বাসুদেব ও রূপনারায়ণের মধ্যবর্তী রাজা মহীন্দ্রনারায়ণের মুদ্রার কথা আমাদের জানা নাই। তাঁহার পর আধুনিক কাল পর্যন্ত মহীন্দ্রনারায়ণ ব্যতীত অন্য সকল কোচরাজারই তারিখহীন ও অসম্পূর্ণ লেখন সমন্বিত মামুলি অর্ধ টঙ্ক আবিষ্কৃত হইয়াছে।
অপর পক্ষে ‘পূর্ব’ কোচরাজ্যে নরনারায়ণের ভ্রাতৃম্পুত্র রঘুদেবনারায়ণও পূর্ণ টঙ্ক নির্মাণ করেন; তাহা নরনারায়ণের মুদ্রার অনুরূপ হইলেও তাঁহার মুখ্য দিকের লেখনে শুধুমাত্র ‘শিবের পরিবর্তে ‘হর-গৌরী’র প্রতি শ্রদ্ধা জানান আছে : যথা (মুখ্যদিকে) ‘শ্রীশ্রীহরগৌরীচরণ-কমলমধুকরস্য’ এবং (গৌণদিকে) ‘শ্রীশ্রীরঘুদেবনারায়ণভূপালস্য শাকে ১৫১০’। রঘুদেবের পুত্র পরীক্ষিত্নারায়ণের মুদ্রার লেখনও অনুরূপ : (মুখ্যদিকে) শ্রীশ্রীহরগৌরী-চরণ-কমলমধুকরস্য ও (গৌণদিকে) ‘শ্রীশ্রীপরীক্ষিনারায়ণ-ভূপালস্য শাকে ১৫২৫’। পূর্বকোচরাজ্যের আর কোন মুদ্রার কথা জানা নাই।
৫
ত্রিপুরারাজ্যের মুদ্রা
ত্রিপুরারাজ্যের মধ্যযুগের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ‘রাজমালা, শিলালেখ ও মুদ্রাই প্রধান। ‘রাজমালা সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে। [এই গ্রন্থ প্রথমে শ্রীকালীপ্রসন্ন সেন তিন খণ্ডে সম্পাদন করেন (১৯২৬-৩১), পরে ত্রিপুরার শিক্ষা অধিকারী এক খণ্ডে প্রকাশিত করিয়াছেন (১৯৬৭)। প্রথমটিকে আমরা “রাজ, ১ম ২য় বা ৩য়” বলিয়া এবং দ্বিতীয়টিকে শুধু “রাজ” বলিয়া উল্লেখ করিব।] বর্তমান ‘রাজমালার যে দুইটি সংস্করণ মুদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়, তুলনামূলকভাবে পাঠ করিলে তাহাদের মধ্যে বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী ও একদেশদর্শী [যেমন, একটিতে বলা হইয়াছে যে, অনন্তমাণিক্য তাঁহার শ্বশুর কর্ত্তৃক নিহত ও সিংহাসনচ্যুত হন (রাজ, ২য়, পৃষ্ঠা ৬৫-৬৬), অন্যটিতে অনন্তমাণিক্যের মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবেই ঘটিয়াছিল বলিয়া দেখান হইয়াছে (রাজ, পৃষ্ঠা ৪৪।১)] উপাদান চোখে পড়ে। কেহ কেহ মনে করেন যে, ‘রাজমালার বর্তমান সংস্করণগুলি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে সংকলিত হইয়াছে। [Cf. D.C. Sircar, JAS. Letters, 1951 pp. 76-77.] একথা আপাতদৃষ্টিতে ঠিক বলিয়াই মনে হয়।
অনেকে মনে করেন রাজা ত্রিপুর হইতেই রাজ্যের ত্রিপুরা নাম হয়। [রাজ, ১ম, পৃ.] কিন্তু প্রাচীন কোন গ্রন্থে বা শিলালেখে ত্রিপুরা নাম পাওয়া যায় না। সুতরাং ত্রিপুরা সম্ভবত ‘টিপ্রা’ নামক উপজাতির নামের সংস্কৃত রূপ। [কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক বন্ধুবর সুহাস চট্টোপাধ্যায় এইরূপ ধারণা পোষণ করেন।] যাহা হউক, ‘রাজমালায় বর্ণিত প্রথম ১৪৪ জন ত্রিপুরার রাজার মধ্যে শেষ দুই একজন ব্যতীত আর সকলেরই কাহিনী নিছক কল্পনাপ্রসূত।
ত্রিপুরায় প্রাপ্ত অতিবিরল শিলালেখগুলি বৈজ্ঞানিক প্রথায় প্রকাশিত না হওয়ায়, সেগুলি ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায় না। [ত্রিপুরার শিক্ষা অধিকার’ ১৯৬৮ খ্রীষ্টাব্দে শিলালিপি-সগ্রহ’ নামে ত্রিপুরার রাজাদের শিলালিপিগুলি প্রকাশ করিয়াছেন, কিন্তু, দুঃখের বিষয়, তাহাদের মধ্যে তিনটি ছাড়া আর কোনটিরই যান্ত্রিক প্রতিলিপি নাই।]
এক্ষেত্রে ত্রিপুরার রাজগণের ইতিহাস-বিশেষতঃকাল নির্ণয়-সম্বন্ধে আমাদের প্রধান সম্বল ত্রিপুরার্ক মুদ্রা। এই মুদ্রা এ পর্যন্ত অতি বিরল ও দুপ্রাপ্য ছিল। সম্প্রতি ইহাদের বিশেষ চাহিদা হওয়ায় মুদ্রাব্যবসায়ীরা বহু ত্রিপুরামুদ্রা বাজারে বাহির করিয়া আনিয়াছেন। তাঁহাদের আনুকূল্যে অধুনা সংগৃহীত মুদ্রার অধিকাংশই আমরা বৈজ্ঞানিক প্রথায় পরীক্ষা করিতে পারিয়াছি।