ধর্মমাণিক্যের রাজ্যকালে ছত্রমাণিক্যের বংশধর (প্রপৌত্র?) জগত্রায় (মতান্ত রে জগত্রাম) রাজ্যলাভের জন্য ঢাকার নায়েব নাজিম মীর হবীবের শরণাপন্ন হইলেন। হবীব প্রকাণ্ড একদল সৈন্য লইয়া ত্রিপুরা আক্রমণ করিলেন এবং জগত্রায়ের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হইয়া সহসা রাজধানী উদয়পুরের নিকট পৌঁছিলেন। রাজা ধর্মমাণিক্য যুদ্ধে প্রথমে কিছু সাফল্য লাভ করিলেও অবশেষে পরাজিত হইয়া পর্বতে পলায়ন করিলেন (আ ১৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দ)।
কেবলমাত্র পার্ব্বত্য অঞ্চল ব্যতীত ত্রিপুরা রাজ্যের অবশিষ্ট সমস্ত অংশই মুসলমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। জগত্রায় স্বাধীন পার্ব্বত্য-ত্রিপুরারাজ্যের রাজা হইয়া জগত্মাণিক্য নামে সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। মুসলমান অধিকৃত ত্রিপুরায় ২২টি পরগণা-চাকলা রোসনাবাদ–তাঁহাকে জমিদারিস্বরূপ দেওয়া হইল। ত্রিপুরারাজ্যের যে অংশ মুসলমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল তাহা বর্তমান বাংলা দেশের ময়মনসিংহ জিলার চতুর্থাংশ, শ্রীহট্টের অর্ধাংশ, নোয়াখালির তৃতীয়াংশ এবং ঢাকা জিলার কিয়দংশ লইয়া গঠিত ছিল। তন্মধ্যে জিলা ত্রিপুরার ছয় আনা অংশমাত্র ত্রিপুরপতিগণের জমিদারি। [শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ প্রণীত “ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত”, ৪৫ পৃষ্ঠা]
এইরূপ রাজ্যলোভী জগত্রায়ের বিশ্বাসঘাতকতায় পাঁচশত বৎসরেরও অধিককাল স্বাধীনতা ভোগ করিয়া ত্রিপুরা রাজ্য নামেমাত্র আংশিকভাবে স্বাধীন থাকিলেও প্রকৃতপক্ষে মুসলমানের পদানত হইল।
ধর্মমাণিক্য বাংলার নবাব শুজাউদ্দীনকে সমস্ত অবস্থা নিবেদন করিলে তিনি জগত্সাণিক্যকে বিতাড়িত করিয়া ধর্মমাণিক্যকে পুনরায় রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। কিন্তু মীর হবীবের অন্যান্য ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হইল না। বরং এই সময় হইতে একজন মুসলমান ফৌজদার সসৈন্যে ত্রিপুরায় বাস করিতেন। ইহার পর জয়মাণিক্য ও ইন্দ্ৰমাণিক্য নামে দুইজন রাজা যথাক্রমে ১৭৩৯ এবং ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজত্ব করেন। অতঃপর ত্রিপুরার রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজসিংহাসন লইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মুসলমান কর্তৃপক্ষের সহায়তায় চক্রান্ত করিয়া এক রাজাকে সরাইয়া অন্য রাজার প্রতিষ্ঠা ও কিছুকাল পরে অনুরূপ চক্রান্তের ফলে পূর্ব রাজার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ইত্যাদি ঘটনা ছাড়া আর বিশেষ কিছু নাই।
৪
কোচবিহারের মুদ্রা
কোচবিহারের প্রথম রাজা বিশ্বসিংহের মুদ্রার উল্লেখ থাকিলেও অদ্যাবধি তাহা আবিষ্কৃত হয় নাই। দুর্গাদাস মজুমদার ‘রাজবংশাবলীতে’ (পৃষ্ঠা ১৬) লিখিয়াছেন যে, ১৩ শতকে মহারাজ বিশ্বসিংহ সিংহাসন লাভ করেন এবং নিজ নামে মুদ্রাঙ্কন করেন। [খানচৌধুরী আমানউল্লা সম্পাদিত ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ (সংক্ষেপে ‘কোচ’) ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮০ ও ২৮১ দ্রষ্টব্য]
রাজবংশাবলীতে বিশ্বসিংহের মুদ্রা সম্বন্ধে একটি কাহিনীও আছে। [শরৎচন্দ্র ঘোষাল কৃত ঐ পুস্তকের অনুবাদ A History of Cooch Behar p. 243 দ্রষ্টব্য। অতঃপর যে মুদ্রাগুলির বিবরণ দেওয়া হইয়াছে তাঁহার চিত্র এই গ্রন্থে আছে। ঐ পুস্তকে (p. 351) যে তিনটি তাম্র মুদ্রার কথা আছে, কোচবিহারের বিকৃত অর্ধ মুদ্রার মত হইলেও সেগুলি প্রকৃতপক্ষে কোচ মুদ্রা নহে, ভুটানে মুদ্রিত কোচ মুদ্রার অনুকরণ মাত্র।] ১৪১৯ শককে (১৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দ) মহারাজ বিশ্বসিংহের সহিত আহোমরাজ সুহুংমুঙের সাক্ষাৎ হইলে বিশ্বসিংহ তাঁহাকে নিজ নামে মুদ্রিত ৫০০ মুদ্রা ও ৫টি হস্তী উপহার দেন। এই মুদ্রাগুলি দেখিয়া আহোমরাজ সুহুংমুঙ বিস্মিত হন এবং খেদের সহিত বলেন যে, তাঁহার বংশে ১৩ জন রাজা রাজত্ব করিলেও কেহই মুদ্রাঙ্কন করেন নাই। ইহার পরে অবশ্য সুহুংমুঙ নিজ নামে মুদ্রাঙ্কন করেন। প্রকৃতপক্ষে, শুধু বিশ্বসিংহই নহেন, তাঁহার ঠিক পরেই সাময়িকভাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠানকারী তাঁহার প্রথম পুত্র নরসিংহেরও কোন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় নাই। তবে তৃতীয় রাজা (বিশ্বসিংহের দ্বিতীয় পুত্র) নরনারায়ণের সময় হইতে কোচ রাজারা প্রায় নিয়মিতভাবেই মুদ্রা নির্মাণ করিয়াছেন।
কোচরাজাদের স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও পিতলের মুদ্রার কথা শোনা গেলেও তাহাদের শুধু রৌপ্য মুদ্রাই পাওয়া যায়। এই মুদ্রাগুলি ছাঁচে পেটা (die struck) ও গোলাকার। ঐগুলি মুসলমান সুলতানদের ‘তখা’ (টঙ্ক বা টাকা) নামক মুদ্রার রীতিতে পাতলা ও অপেক্ষাকৃত বৃহদাকারে প্রায় ১৭২ গ্ৰেণ (বা ১১.১৫ গ্রাম) ওজনে প্রস্তুত হইত। এগুলিতে কোন চিত্রণ (device) থাকে না, সুলতানদের মুদ্রার মতই ইহাদের মুখ্য (obverse) ও গৌণ দিকে (reverse) শুধু লেখন (legend বা inscription) থাকে। তবে সেই লেখন সংস্কৃত ভাষায় ও বাংলা অক্ষরে লিখিত হয়। কোচমুদ্রার মুখ্যদিকে রাজার বিরূদ (epithet) ও গৌণদিকে রাজার নাম ও শকাব্দে তারিখ লেখা হয়। কোচ রাজাদের বিরূদগুলি তাঁহাদের উপাস্য দেবদেবীর নাম ঘোষণা করে; যথা, ‘শিবচরণ-কমল-মধুকর’ বা ‘হর-গৌরী-চরণকমল-মধুকর।
কথিত আছে যে, চতুর্থ কোচরাজ লক্ষ্মীনারায়ণের সময় তদ্বারা শাসিত পশ্চিম কোচরাজ্য মুঘল বাদশাহের মিত্ররাজ্যরূপে পরিগণিত হইবার পর কোচরাজারা পূর্ণ টঙ্ক মুদ্রিত করিবার অধিকারে বঞ্চিত হন। একথা সম্ভবত ঠিক নহে। কারণ লক্ষ্মীনারায়ণের পৌত্র প্রাণনারায়ণেরও অর্ধ মূদ্রার সহিত ‘পূর্ণ মুদ্রাও’ পাওয়া যায়; অবশ্য প্রাণনারায়ণের পরবর্তী রাজাদের মুদ্রাগুলি ‘পূর্ণ’ টঙ্ক নহে, ‘অর্ধ’ টঙ্ক। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, একদিকে নরনারায়ণ, লক্ষ্মীনারায়ণ ও প্রাণনারায়ণ এবং অপরদিকে নরনারায়ণের ভ্রাতুষ্পুত্র ‘পূর্ব কোচরাজ্যের অধীশ্বর রঘুদেবনারায়ণ ও তাঁহার পুত্র পরীক্ষিতনারায়ণই পূর্ণ টঙ্ক মুদ্রিত করিয়াছিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ ও প্রাণনারায়ণ যে অর্ধ মুদ্রাগুলি নির্মাণ করেন, সেগুলি তাঁহাদের পূর্ণ মুদ্রারই ক্ষুদ্রতর সংস্করণ।