ধর্মমাণিক্যের পরবর্তী রাজা রত্নমাণিক্য সম্বন্ধে ‘রাজমালায় বিস্তৃত বর্ণনা আছে। গৌড়েশ্বরের অনুমতিক্রমে তিনি দশ হাজার বাঙালীকে ত্রিপুরায় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। রত্নমাণিক্য যে বাংলা দেশীয় হিন্দুদের সংস্কৃতি ও সামজিক আচার-ব্যবহার সম্বদ্ধে প্রথমে খুবই অজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু কিছু কাল পরে তাঁহার দিকে আকৃষ্ট হন-রাজমালায় তাঁহার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। সুতরাং রত্নমাণিক্যের সময় হইতেই যে ত্রিপুরার সাহিত বাংলার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হয় এবং বাংলার হিন্দুসংস্কৃতি ও সভ্যতা ত্রিপুরায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। রত্নমাণিক্য অন্ততঃ ১৪৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন।
এই সময়ে সৈন্যগণ খুব প্রবল হইয়া উঠে এবং যখন যাহাকে ইচ্ছা করে তাহাকেই সিংহাসনে বসায়। রাজা ধন্যমাণিক্য (১৪৯০-১৫১৪) ইহাদের দমন করেন এবং চয়চাগ নামক ব্যক্তিকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি ত্রিপুরার পূর্বদিকস্থিত কুকিদিগকে পরাজিত করিয়া তাহাদের পার্ব্বত্য বাসভূমি ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং চট্টগ্রাম অধিকার করিয়াছিলেন। হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দ) বাংলা দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়ন করিয়া পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি আক্রমণ করেন। আসাম ও উড়িষ্যায় বিফল হইয়া তিনি ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। ইহার বিবরণ পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে (ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)।
ধন্যমাণিক্যের পরে উল্লেখযোগ্য রাজা বিজয়মাণিক্য (১৫৩২-৬৩) আকবরের সমসাময়িক ছিলেন এবং আইন-ই-আকবরীতে স্বাধীন ত্রিপুরার রাজা বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছেন। তিনি একদল পাঠান অশ্বারোহী সৈন্য গঠন করেন এবং শ্রীহট্ট, জয়ন্তিয়া ও খাসিয়ার রাজাদিগকে পরাজিত করেন। কররাণী রাজাগণের সঙ্গে তাঁহার সংঘর্ষের কাহিনী এবং সোনার গাঁ ও পদ্মানদী পর্যন্ত অভিযানের কাহিনী সমসাময়িক মুদ্রার প্রমাণে সমর্পিত হইয়াছে।
পরবর্তী প্রসিদ্ধ রাজা উদয়মাণিক্য রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন নাই। তাঁহার রাজ-জামাতাকে হত্যা করিয়া ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন (১৫৬৭)। তিনি রাজধানী রাঙ্গামাটিয়ার নাম পরিবর্তন করিয়া নিজের নামানুসারে উদয়পুর এই নামকরণ করিলেন। কথিত আছে যে মুঘলসৈন্য চট্টগ্রাম অধিকার করিতে অগ্রসর হইলে তিনি মুঘল সৈন্যের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ করিয়া পরাস্ত হন।
উদয়মাণিক্যের পুত্র জয়মাণিক্যকে (১৫৭৩) বধ করিয়া বিজয়মাণিক্যের ভ্রাতা অমরমাণিক্য ত্রিপুরার রাজসিংহাসনে আরোহণ করিলেন (১৫৭৭-৮১ খ্রী)। এইরূপে ত্রিপুরার পুরাতন রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইল। তিনি একদিকে আরাকানরাজ ও অন্যদিকে বাংলার মুসলমান সুবাদারের আক্রমণ হইতে ত্রিপুরারাজ্য রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন এবং শ্রীহট্ট জয় করিয়াছিলেন।
অমরমাণিক্যের পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের জন্য ঘোরতর বিরোধ হয়। এই সুযোগে আরাকানরা ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর আক্রমণ করিয়া লুণ্ঠন করিলেন। মনের দুঃখে অমরমাণিক্য বিষ খাইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তাঁহার পৌত্র যশোধরমাণিক্যের রাজত্বকালে (১৬০০-১৬২৫ খ্রী) বাংলার সুবাদার ইব্রাহিম খান ত্রিপুরারাজ্য আক্রমণ করেন (১৬১৮ খ্রীষ্টাব্দ)। এই সময়ে মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর আরাকানরাজকে পরাস্ত করিবার জন্য ইব্রাহিম খানকে আদেশ করেন। সম্ভত আরাকান অভিযানের সুবিধার জন্যই ইব্রাহিম প্রথমে ত্রিপুরা জয়ের সংকল্প করিয়াছিলেন। ইহার জন্য তিনি বিপুল আয়োজন করেন। উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম হইতে দুইদল সৈন্য স্থলপথে এবং রণতরীগুলি গোমতী নদী দিয়া রাজধানী উদয়পুরের দিকে অগ্রসর হইল। ত্রিপুরারাজ বীরবিক্রমে বহু যুদ্ধ করিয়াও মুঘলসৈন্য বা রণতরীর অগ্রগতি রোধ করিতে পারিলেন না এবং মুঘলেরা উদয়পুর অধিকার করিল। রাজা আরাকানে পলাইয়া যাইতে চেষ্টা করিলেন কিন্তু মুঘলসৈন্য তাঁহার পশ্চাদানুসরণ করিয়া তাঁহাকে সপরিবারে ও বহু ধনরত্নসহ বন্দী করিল। বিজয়ী মুঘল সেনাপতি কিছু সৈন্য উদয়পুরে রাখিয়া বহু হস্তী ও ধনরত্নসহ বন্দী রাজাকে লইয়া সুবাদারের নিকট উপস্থিত হইলেন।
ত্রিপুরাবাসিগণ অতঃপর কল্যাণমাণিক্যকে রাজপদে বরণ করেন (১৬২৬ খ্রী)। তাঁহার সহিত প্রাচীন রাজবংশের কোন সম্বন্ধ ছিল কিনা তাহা সঠিক জানা যায় না। তাঁহার সময়েও সম্ভবত বাংলার সুবাদার শাহ্ শুজা ত্রিপুরা আক্রমণ করিয়াছিলেন। কল্যাণের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র গোবিন্দমাণিক্য সিংহাসনে আরোহণ করিলে (১৬৬০) কনিষ্ঠ পুত্র নক্ষত্ররায় বাংলার সুবাদারের সাহায্যে সিংহাসনলাভের জন্য চেষ্টা করেন। গোবিন্দ ভ্রাতৃ-বিরোধের অবশ্যম্ভাবী অশুভ ফলের কথা চিন্তা করিয়া স্বেচ্ছায় রাজ্য ত্যাগ করেন এবং নক্ষত্ররায় ছত্রমাণিক্য নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৬৬১ খ্রী)। এই কাহিনী অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রাজর্ষি’ উপন্যাস ও ‘বিসর্জন’ নাটক রচনা করেন। গোবিন্দমাণিক্যের মুদ্রা ও শিলালিপির তারিখ যথাক্রমে ১৬৬০ ও ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দ।
ছত্রমাণিক্যের মৃত্যুর পর অথবা অন্য কোন উপায়ে গোবিন্দমাণিক্য পুনরায় রাজ্যভার গ্রহণ করেন (১৬৬১-৬২ খ্রী)। তাঁহার পর তাঁহার পুত্র রামদেবমাণিক্য (১৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দ) ও পৌত্র দ্বিতীয় রত্নমাণিক্য (১৬৮৫ খ্রীষ্টাব্দ) রাজত্ব করেন। রত্নমাণিক্য (২য়) অল্পবয়সে সিংহাসনে আরোহণ করায় রাজ্যে অনেক গোলযোগ ও অত্যাচার হয়। তিনি শ্রীহট্ট আক্রমণ করিয়াছিলেন বলিয়া ইহার শাস্তিস্বরূপ বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করেন। ‘রাজমালায় বর্ণিত হইয়াছে যে রাজা রত্নমাণিক্যের পিতৃব্য-পুত্র নরেন্দ্ৰমাণিক্য শায়েস্তা খানকে ত্রিপুরাযুদ্ধে সহায়তা করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পুরস্কারস্বরূপ শায়েস্তা খান তাঁহাকে ত্রিপুরার রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রত্নমাণিক্য ও তাঁহার তিন পুত্রকে বন্দী করিয়া সঙ্গে লইয়া যান (১৬৯৩ খ্রী)। কিন্তু তিন বৎসর পরে শায়েস্তা খান নরেন্দ্রমণিক্যকে রাজ্যচ্যুত করিয়া পুনরায় রত্নমাণিক্যকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করেন (১৬৯৬ খ্রী)। রত্নমাণিক্যা প্রায় ১৬ বৎসর রাজত্ব করার পর তাঁহার ভ্রাতা মহেন্দ্ৰমাণিক্য তাঁহাকে বধ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৭১২ খ্রীষ্টাব্দ)। মহেন্দ্রমাণিক্যের পর তাঁহার ভ্রাতা ধর্মমাণিক্য (২য়) সিংহাসন অধিকার করেন (১৭১৪ খ্রীষ্টাব্দ)।