এই সন্ধি স্থাপনের পরে বাংলার নবাবের সহিত রূপনারায়ণের মিত্রতা স্থাপিত হইয়াছিল এবং তিনি মুর্শিদকুলী খাঁর দরবারে উকিল পাঠাইয়াছিলেন।
রূপনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র উপেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ৫০ বৎসর রাজত্ব করেন (১৭১৪-৬৩ খ্রী)। তাঁহার দত্তক-পুত্র বিদ্রোহী হইয়া রংপুরের ফৌজদারের সাহায্যে কোচবিহার রাজ্য দখল করেন। উপেন্দ্রনারায়ণ ভুটানের রাজার সাহায্যে যুদ্ধ করিয়া মুঘলসৈন্য পরাস্ত করেন এবং পুনরায় সিংহাসন অধিকার করেন (১৭৩৭-৩৮ খ্রী)। মুঘলের সহিত কোচবিহারের ইহাই শেষ যুদ্ধ। ভুটান-রাজের সাহায্য গ্রহণের ফলে রাজ্যে ভুটিয়াদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অনেক বাড়িল এবং পরবর্তীকালে ইহার ফলে নানারূপ অশান্তি ও উপদ্রবের সৃষ্টি হইয়াছিল।
৩
ত্রিপুরা
ত্রিপুরার রাজবংশ যে খুবই প্রাচীন এবং মধ্যযুগের পূর্বেও বিদ্যমান ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। মধ্যযুগে এই রাজ্যের ও রাজবংশের একখানি ইতিহাস (বাংলা পদ্যে) রচিত হইয়াছিল। এই গ্রন্থের প্রস্তাবনায় উক্ত হইয়াছে যে রাজা ধর্মমাণিক্যের আদেশে বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর নামক দুইজন প্রধান এবং চন্তাই (প্রধান পূজারী) দুর্লভেন্দ্র কর্ত্তৃক এই গ্রন্থ রচিত হয়। ধর্মমাণিক্য পঞ্চদশ খ্রীষ্টাব্দে রাজত্ব করেন। এই গ্রন্থের মূল সংস্করণ এখন আর পাওয়া যায় না। কিন্তু পরবর্তীকালে ইহা পরিবর্ধিত আকারে যে রূপ ধারণ করে বর্তমানে তাহাই ‘রাজমালা নামে পরিচিত। [ইহার দুইটি সংস্করণ মুদ্রিত হইয়াছে। প্রথমটি শ্ৰীকালীপ্রসন্ন সেন সম্পাদন করেন (১৯৩১ ৩৬ খ্রীষ্টাব্দে)। দ্বিতীয়টি ১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরা সরকার প্রকাশিত করেন। এই দুইটি সংস্করণের মধ্যে অনেক তারতম্য দেখা যায়।]
রাজমালায় বর্ণিত হইয়াছে যে চন্দ্রবংশীয় যযাতি স্বীয় পুত্র দ্রুহু্যকে কিরাতদেশে রাজা করিয়া পাঠান এবং এই বংশে ত্রিপুর নামক রাজার জন্ম হয়। ইহার সময় হইতেই রাজ্যের নাম হয় ত্রিপুরা। ইনি দ্বাপরের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন এবং ‘রাজমালার সম্পাদকের মতে সম্ভবত যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন।
এই সমুদয় কাহিনীর যে কোন ঐতিহাসিক মূল্য নাই তাহা বলাই বাহুল্য। ত্রিপুরের পরবর্তী ৯৩ জন রাজার পরে ছেংথুম-ফা রাজার নাম পাওয়া যায়। ‘রাজমালা অনুসারে ইনি গৌড়েশ্বরকে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং এই গৌড়েশ্বর যে মুসলমান নরপতি ছিলেন সাহা সহজেই অনুমান করা যায়। সুতরাং এই রাজার সময় হইতেই ত্রিপুরার ঐতিহাসিক যুগের আরম্ভ বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে।
বাংলার মুসলমান সুলতান গিয়াসুদ্দিন ইউয়জ শাহ (১২১২-২৭ খ্রীষ্টাব্দ) পূর্ববঙ্গ ও কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিলেন, কিন্তু নাসিরুদ্দীন মাহমুদের আক্রমণ সংবাদ পাইয়া ফিরিয়া যান। সম্ভবত ইহাই পরবর্তীকালে কোন গৌড়াধিপতির ত্রিপুরা আক্রমণ ও পরাজয়রূপে বর্ণিত হইয়াছে।
রাজমালায় বর্ণিত হইয়াছে যে ছেংথুম-ফার প্রপৌত্র ডাঙ্গর-ফার আঠারোটি পুত্র ছিল। সর্বকনিষ্ঠ রত্ন-ফা গৌড়ের রাজদরবারে কিছুদিন অবস্থান করেন এবং গৌড়েশ্বরের সৈন্যের সহায়ে ত্রিপুরার রাজসিংহাসন লাভ করেন। এই গৌড়েশ্বর নিঃসন্দেহে বারবক্ শাহ (১৪৫৫-১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দ)। রত্ন-ফা গৌড়েশ্বরকে একটি বহুমূল্য রত্ন উপহার দেন। গৌড়েশ্বর তাঁহাকে মাণিক্য উপাধি দেন। এতকাল ত্রিপুরার রাজগণ নামের শেষে ‘ফা’ উপাধি ব্যবহার করিতেন; স্থানীয় ভাষায় ‘ফা’-র অর্থ পিতা। অতঃপর ‘ফা’-র পরিবর্তে রাজাদের নামের শেষে মাণিক্য ব্যবহৃত হয়। সুতরাং রত্ন-ফা হইলেন রমাণিক্য।
‘রাজমালার’ এই কাহিনী কতদূর সত্য তাহা বলা যায় না। তবে পূর্ব্বোক্ত রাজা ধর্মমাণিক্য যে রত্নমাণিক্যের পূর্ববর্তী, মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে তাহা জানা যায়। সুতরাং রত্নমাণিক্যই যে সর্বপ্রথম মাণিক্য’ উপাধি গ্রহণ করেন এই উক্তি সত্য নহে।
‘রাজমালায়’ এই সময়কার রাজবংশের যে তালিকা আছে মুদ্রার প্রমাণে তাহা ভ্রান্ত প্রমাণিত হইয়াছে। প্রকৃত বংশাবলী সম্বন্ধে পরিশিষ্টে আলোচনা করা হইয়াছে।
রাজমালায় বর্ণিত ত্রিপুরার রাজাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ধর্মমাণিক্যের তারিখই সঠিক জানা যায়, কারণ তাঁহার একখানি তাম্রশাসনে ১৩৮০ শক অর্থাৎ ১৪৫৮ খ্রীষ্টাব্দের উল্লেখ আছে। “ত্রিপুর-বংশাবলী অনুসারে ধর্মমাণিক্য ৮৪১ হইতে ৮৭২ ত্রিপুরাব্দ অর্থাৎ ১৪৩১ হইতে ১৪৬২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ‘রাজমালায় ইঁহার পিতার নাম মহামাণিক্য, তাম্রশাসনে তাহাই আছে। সুতরাং অন্তত এই সময় হইতে ত্রিপুরার প্রচলিত ঐতিহাসিক বিবরণ মোটামুটি সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। ধর্মমাণিক্যই যে ‘রাজমালা’-নামক ত্রিপুরার ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রণয়ন করান তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।
রাজা ধর্মমাণিক্যের পূর্বে বাংলার মুসলমান সুলতানগণ ত্রিপুরা আক্রমণ করিয়া ইহার কতকাংশ অধিকার করেন এবং ধর্মমাণিক্য তাঁহার পুনরুদ্ধার করেন–এই প্রচলিত কাহিনী কতদূর সত্য বলা যায় না। তবে শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৩০১-১৩২২ খ্রীষ্টাব্দ) ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট প্রভৃতি তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন, ফকরুদ্দীন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করিয়াছিলেন, শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-৫৮ খ্রীষ্টাব্দ) সোনারগাঁও ও কামরূপের কতক অংশ জয় করিয়াছিলেন ত্রিপুরার কতক অংশ জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের (১৪১৮-৩৩ খ্রীষ্টাব্দ) রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল–ইহা গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদসমূহে বলা হইয়াছে এবং ইহারা সম্ভবত ত্রিপুরা রজ্যেরও কতক অংশ জয় করিয়াছিলেন। কিন্তু শেষোক্ত সুলতানের মৃত্যুর পর হইতে রুকনুদ্দীন বারবক শাহের (১৪৫৫-৭৬ খ্রীষ্টাব্দ) রাজত্বের মধ্যবর্তী ২২ বৎসর কাল মধ্যে বাংলার সুলতানগণ খুব প্রভাবশালী ছিলেন না–আভ্যন্তরিক গোলযোগও ছিল। সুতরাং এই সুযোগে ধর্মমাণিক্য সম্ভবত ত্রিপুরার বিজিতাংশ উদ্ধার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।