সাত বৎসর রাজত্ব করিয়া বীরনারায়ণের মৃত্যু হইলে তাঁহার পুত্র প্রাণনারায়ণ রাজা হন এবং ৩৩ বৎসর রাজত্ব করেন (১৬৩৩-৬৬ খ্রী)। প্রাণনারায়ণ রাজভক্ত সামন্তের ন্যায় আহোমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘলসৈন্যের সাহায্য করেন। কিন্তু ১৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের অসুখের সংবাদ পাইয়া যখন বাংলার সুবাদার শুজা দিল্লির সিংহাসনের জন্য ভ্রাতা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন তখন সুযোগ বুঝিয়া প্রাণনারায়ণ ঘোড়াঘাট অঞ্চল লুঠ করিলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া মুঘল সম্রাটকে কর দেওয়া বন্ধ করিলেন। ইহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া প্রাণনারায়ণ কামরূপ আক্রমণ করিলেন এবং মুঘল ফৌজদারের সৈন্যগণকে পরাজিত করিয়া হাজো পর্যন্ত অধিকার করিলেন। কিন্তু আহোমরাজ কোচবিহারের এই জয়লাভে ভীত হইয়া কোচবিহার রাজ্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। গৌহাটির মুঘল ফৌজদার দুই দিক হইতে আক্রমণে ভীত হইয়া ঢাকায় পলায়ন করিলেন। আহোমসৈন্য বিনা আয়াসে গৌহাটি অধিকার করিল। অতঃপর কামরূপের অধিকার লইয়া কোচবিহার ও আহোম রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ হইল। প্রাণনারায়ণ মুঘলসৈন্য তাড়াইয়া ধুবড়ী অধিকার করিলেন। কিন্তু পরিণামে আহোমদেরই জয় হইল এবং কোচবিহাররাজ কামরূপের আশা পরিত্যাগ করিয়া স্বীয় রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
ঔরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই মীরজুমলাকে বাংলার সুবাদার পদে নিযুক্ত করিলেন এবং বাংলার বিদ্রোহী জমিদারদিগকে কঠোর হস্তে দমন করিবার নির্দেশ দিলেন। প্রাণনারায়ণ ভীত হইলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া মীরজুমলার নিকট দূত পাঠাইলেন। মীরজুমলা দূতকে বন্দী করিলেন এবং কোচবিহারের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইলেন। অবশেষে স্বয়ং সসৈন্যে কোচবিহার শহরের নিকট পৌঁছিলেন। প্রাণনারায়ণ রাজধানী ত্যাগ করিয়া ভুটানে পলায়ন করিলেন। কোচবিহার মীরজুমলার হস্তগত হইল (১৯শে ডিসেম্বর, ১৬৬১ খ্রী)। মীরজুমলা কোচবিহার। মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিলেন এবং ইহার শাসনের জন্য ফৌজদার, দিওয়ান, প্রভৃতি নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু তিনি আসাম অভিযানে যাত্রা করিবার পরেই কোচবিহারে জমির রাজস্ব আদায় সম্বন্ধে নূতন ব্যবস্থা করার ফলে প্রজারা বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। বর্ষাগমে মীরজুমলার সৈন্য আসামে বিষম দুরবস্থায় পড়িল এবং কোচবিহারে মুঘলসৈন্য আসার কোন সম্ভাবনা রহিল না। এই সুযোগে রাজা প্রাণনারায়ণ ফিরিয়া আসিলেন। মুঘলসৈন্য কোচবিহার ত্যাগ করিতে বাধ্য হইল এবং প্রাণনারায়ণ পুনরায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করিলেন (মে, ১৬৬২ খ্রীষ্টাব্দ)।
ইহার অনতিকাল পরেই মীরজুমলার মৃত্যু হইল (১৬ মার্চ, ১৫৬৬ খ্রী) এবং পর বৎসর শায়েস্তা খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন। তিনি রাজমহল পর্যন্ত আসিয়াই রাজধানী যাইবার পথে কোচবিহার জয় করিতে মনস্থ করিলেন। প্রাণনারায়ণের স্বাস্থ্য তখন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে; রাজ্যের অভ্যন্তরেও নানা গোলযোগ। সুতরাং তিনি মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করাই যুক্তিযুক্ত মনে করিলেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে দূত পাঠাইলেন এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণস্বরূপ মুঘল সুবাদারকে সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে স্বীকৃত হইলেন। শায়েস্তা খান ইহাতে রাজী হইলেন (১৬৬৫ খ্র) এবং কোচবিহারের সীমান্ত হইতে মুঘলসৈন্য ফিরাইয়া আনিলেন। ইহার কয়েক মাস পরেই রাজা প্রাণনারায়ণের মৃত্যু হইল (১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ)।
প্রাণনারায়ণের মৃত্যুর পর হইতেই কোচবিহারের আভ্যন্তরিক বিশৃঙ্খলা ক্রমশঃ বাড়িয়া চলিল। তাঁহার পুত্র মোদনারায়ণ ১৪ বৎসর রাজত্ব করেন (১৬৬৬-৮০ খ্রী), কিন্তু প্রাণনারায়ণের খুল্লতাত নাজীর মহীনারায়ণ এবং তাঁহার পুত্রেরাই প্রকৃত ক্ষমতা পরিচালনা করিতেন। ইহার ফলে রাজ্যে নানা গোলযোগের সৃষ্টি হইল। পরবর্তী রাজা বাসুদেবনারায়ণ মাত্র দুই বৎসর রাজত্ব করেন (১৬৮০ ৮২ খ্রী)। অতঃপর প্রাণনারায়ণের প্রপৌত্র মহীন্দ্রনারায়ণ (১৬৮২-৯৩ খ্রী) পাঁচ বৎসর বয়সে রাজা হইলেন কিন্তু নাজীর মহীনারায়ণের দুই পুত্র জগত্নারায়ণ ও যজ্ঞনারায়ণই রাজ্য চালাইতেন। তাহাদের অত্যাচারে রাজ্যে নানাবিধ অশান্তির সৃষ্টি হইল। এমন কি চাকলার ভারপ্রাপ্ত বহু কর্মচারী স্বাধীন রাজার ন্যায় ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ মুঘলদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিতে লাগিলেন। এই সুযোগে মুঘল সুবাদার পুনরায় কোচবিহার রাজ্য হস্তগত করিতে চেষ্টা করিলেন। ১৬৮৫, ১৬৮৭ ও ১৬৮৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনটি সামরিক অভিযানের ফলে কোচবিহারের কতক অংশ মুঘলদের হস্তগত হইল।
অবশেষে কোচবিহাররাজ মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। যজ্ঞনারায়ণ সেনাপতি নিযুক্ত হইলেন এবং ভুটিয়ারাও তাঁহাকে সাহায্য করিল। দুই বৎসর (১৬৯১-৯৩ খ্রী) যাবৎ যুদ্ধ চলিল। অনেক পরগণার বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীরা মুঘল সুবাদারকে কর দিয়া জমির মালিকানাস্বত্ব লাভ করিল। এই ভাবে ক্রমে ক্রমে কোচবিহার রাজ্যের অনেক অংশ মুঘলের অধিকারে আসিল।
রাজা মহীন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর (১৬৯৩ খ্রী) কিছুদিন পর্যন্ত গোলমাল চলিল। পরে তাঁহার পুত্র রূপনারায়ণ রাজত্ব করেন (১৭০৪-১৪ খ্রী)। তিনিও কিছুদিন যুদ্ধ করিলেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ এই তিনটি প্রধান চাকলাও মুঘলেরা দখল করিল। ১৭১১ খ্রীষ্টাব্দে সন্ধি হইল। রূপনারায়ণ বর্তমান কোচবিহার রাজ্য পাইলেন এবং স্বাধীনতার চিহ্নস্বরূপ নিজ নামে মূদ্রা প্রচলনের অধিকারও বজায় রহিল। কিন্তু তিনি উল্লিখিত তিনটি চাকলার উপর শুধুমাত্র নামে বাদশাহের প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া উহা নিজের অধীনে রাখার জন্য মুঘল বাদশাহকে কর দিতে স্বীকৃত হইলেন। কিন্তু নিজের নামে কর দেওয়া অপমানজনক মনে করায় ছত্রনাজীর কুমার শান্তনারায়ণের নামে ইজারাদার হিসাবে কর দেওয়া হইবে এইরূপ স্থির হইল।