কোচরাজ আহোমদিগকে পরাজিত করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। কাছাড়, মণিপুর, জয়ন্তিয়া, খয়রাম, দিমরুয়া, শ্রীহট্ট প্রভৃতি দেশেও সাময়িক অভিযান করিয়াছিলেন এবং এই সমুদয় দেশের রাজগণের অনেকেই পরাজিত হইয়া কোচরাজকে কর দিতে স্বীকৃত হইয়াছিলেন। এই প্রকারে ষোড়শ শতাব্দের শেষার্ধে কোচবিহার রাজ্য ভারতের পূর্ব সীমান্তে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়।
এই সময়ে বাংলা দেশের অধিকার লইয়া পাঠান ও মুঘলেরা ব্যস্ত থাকায় কোচরাজ সেদিক হইতে কোন বাধা পান নাই। কিন্তু কররাণী বংশ বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে সুলেমান কররাণী কোচরাজ্য আক্রমণ করেন। ইহার বিবরণ প্রথম পরিচ্ছেদেই দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু অনতিকাল পরেই বাংলা দেশে পাঠানদের ধ্বংসের উপর মুঘল রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। নরনারায়ণ মুঘলদের সহিত মৈত্রী স্থাপনের জন্য আকবরের রাজসভায় বহু উপঢৌকনসহ এক দূত পাঠান এবং মুঘলরাজ ও নরনারায়ণ দুই সমকক্ষ রাজার ন্যায় সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। (১৫৭৮ খ্রীষ্টাব্দে)। বাংলা দেশে মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রায় চারি শত বৎসর পরে এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম হিন্দু ও মুসলমান রাজ্যের মধ্যে শান্তিসূচক সন্ধি স্থাপিত হইল।
কিন্তু শীঘ্রই কোচবিহার রাজ্যে একটি গুরুতর পরিবর্তন ঘটিল। রাজা নরনারায়ণ বৃদ্ধবয়সে বিবাহ করেন এবং তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র রঘুদেবকে রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু নরনারায়ণের পর এক পুত্র হওয়ায় রঘুদেব রাজ্যলাভে নিরাশ হইয়া পূর্বদিকে মানস নদীর অপর পারে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিলেন। ভ্রাতুষ্পুত্রকে দমন করিতে না পারিয়া কোচরাজ তাঁহার সহিত আপসে মিটমাট করিলেন। স্থির হইল নরনারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ সঙ্কোশ নদীর পশ্চিম ভূভাগে রাজত্ব করিবেন এবং উক্ত নদীর পূর্ব অংশে রঘুদেব রাজা হইবেন। এইরূপে কোচবিহার রাজ্য দুইভাগে বিভক্ত হইল। পূর্বদিকের রাজ্য সাধারণত প্রাচীন কামরূপ নামেই পরিচিত হইত। এই বিভাগের ফলে কোচবিহার রাজ্য দুর্বল হইয়া পড়িল এবং ইহার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অনেক কমিয়া গেল। আর এই দুই রাজ্যের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে উভয়েই মুঘলের পদানত হইল।
১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দে নরনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ কোচবিহারের রাজসিংহাসনে আরোহণ করিলেন। বীরত্ব ও অন্যান্য রাজোচিত গুণ তাঁহার কিছুমাত্র ছিল না। ওদিকে রঘুদেবও স্বাধীন রাজার ন্যায় নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ স্বয়ং রঘুদেবের সহিত যুদ্ধ করিতে ভরসা না পাইয়া রঘুদেবের পুত্র পরীক্ষিতকে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উত্তেজিত করিলেন। রঘুদেব কঠোর হস্তে এই বিদ্রোহ দমন করিলে পরীক্ষিত লক্ষ্মীনারায়ণের আশ্রয় লাভ করিল। লক্ষ্মীনারায়ণের সহিত মুঘলরাজের সখ্যতার কথা স্মরণ করিয়া রঘুদেব মুঘলশ ঈশাখার সহিত বন্ধুত্ব করিলেন এবং কোচবিহার রাজ্যের অন্ত ভুক্ত বাহিরবন্দ পরগণা জয় করিতে মনস্থ করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ নিরুপায় হইয়া এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করিলেন (১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দে)। রঘুদেব বাহিরবন্ধ অধিকার করিয়া কোচবিহার আক্রমণ করিলেন। এই সময় মানসিংহ বাংলার শাসনকর্ত্তা ছিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ সাহায্য প্রার্থনা করিলে মানসিংহ সৈন্য পাঠাইলেন। রঘুদেব পরাজিত হইয়া কামরূপে ফিরিয়া গেলেন। বাহিরবন্দ পুনরায় কোচবিহার রাজ্যের অধীন হইল। এই যুদ্ধের বিবরণ পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে (নবম পরিচ্ছেদ)। ইসলাম খা মুঘল সুবাদাররূপে বাংলা দেশে আসিয়া কিরূপে বিদ্রোহী হিন্দু জমিদার ও পাঠান নায়কগণকে পরাজিত করিয়া মুঘল-শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তাহা পূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে (নবম পরিচ্ছেদ)। কোচবিহার ও কামরূপের পরস্পর বিবাদের সুযোগে এই উভয় রাজ্যই মুঘলের পদানত হইল। কামরূপের রাজা রঘুদেবের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র পরীক্ষিতনারায়ণ রাজ হইলেন। তিনিও পিতার ন্যায় কোচবিহারের অধীনস্থ বাহিরবন্দ পরগণা অধিকার করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া গুরুতররূপে পরাজিত হইলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ আহোম রাজার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। কিন্তু বিফল-মনোরথ হইয়া ইসলাম খাঁর শরণাপন্ন হইলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ সম্পূর্ণরূপে মুঘলের দাসত্ব স্বীকার করিলে ইসলাম খাঁ তাঁহাকে সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরীক্ষিত মুঘল সাম্রাজ্যের সামন্ত সুসঙ্গের রাজা রঘুনাথের পরিবারবর্গকে বন্দী করিয়াছিলেন। সুতরাং রঘুনাথও লক্ষ্মীনারায়ণের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া ইসলাম খাঁর দরবারে উপস্থিত হইলেন। মুঘল সম্রাটকে করদানে সম্মত হইয়া লক্ষ্মীনারায়ণ মুঘলের দাসত্ব স্বীকার করিলেন। এইরূপে স্বাধীন কোচবিহার রাজ্যের অবসান হইল।
অতঃপর লক্ষ্মীনারায়ণের প্ররোচনায় ইসলাম খাঁ কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণও পশ্চিমদিকে হইতে কামরূপ আক্রমণ করিলেন। পরীক্ষিত সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করিলেন (১৬১৩ খ্রীষ্টাব্দ)।
লক্ষ্মীনারায়ণ আশা করিয়াছিলেন যে পরাজিত রাজ্যের এক অংশ তিনি পাইবেন। যুদ্ধ শেষ হইবার পরে কামরূপ রাজ্যের শাসনভার তাহাকে দেওয়ায় এই আশা বদ্ধমূল হইল; কিন্তু অকস্মাৎ ইসলাম খাঁর মৃত্যু হওয়ায় (১৬১৩ খ্রী) সম্পূর্ণ অবস্থা-বিপর্যয় ঘটিল। লক্ষ্মীনারায়ণ নূতন সুবাদার কাশিম খাঁর সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করিলে তিনি প্রথমে তাঁহাকে সাদরে অভ্যর্থনা করিলেন কিন্তু পরিশেষে তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিলেন। এই সংবাদে কোচবিহার রাজ্যে বিদ্রোহ উপস্থিত হইল, কিন্তু মুঘলসৈন্য সহজেই ইহা দমন করিল। অতঃপর লক্ষ্মীনারায়ণের পুত্র কোচবিহারের রাজপদে অভিষিক্ত হইলেন। লক্ষ্মীনারায়ণের বন্দীদশার সংবাদ ঠিক জানা যায় না। সম্ভবত এক বৎসর তাঁহাকে ঢাকায় রাখিয়া সম্রাটের দরবারে পাঠানো হয়। ১৬১৭ খ্রীষ্টাব্দে কাশিম খানের পরিবর্তে ইব্রাহিম খান নূতন সুবাদার হইয়া বাংলায় আসেন। তাঁহার অনুরোধে সম্রাট জাহাঙ্গীর লক্ষ্মীনারায়ণকে মুক্তি দেন (১৬১৭ খ্রী)। কিন্তু কোচবিহারে রাজত্ব করা তাঁহার অদৃষ্টে ছিল না। লক্ষ্মীনারায়ণ বাংলা দেশে ফিরিয়া আসিলে বাংলার সুবাদার তাঁহাকে কামরূপের মুঘল শাসনের সাহায্যার্থে তথায় প্রেরণ করেন। তিনি প্রায় দশ বৎসর কামরূপে অবস্থান করেন এবং সেখানেই তাঁহার মৃত্যু হয় (১৬২৬ অথবা ১৬২৭ খ্রীষ্টাব্দ)। পুত্র বীরনারায়ণ তাঁহার পরামর্শ অনুসারে কোচবিহারের রাজকার্য চালাইতে থাকেন এবং পিতার মৃত্যুর পর নিজ নামে রাজ্য শাসন করেন। তিনি মুঘলদরবারে রীতিমত কর পাঠাইতেন।