পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত শাহ জলালের দরগা’ আলাউদ্দীন আলী শাহই প্রথম নির্মাণ করাইয়াছিলেন।
৪
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের পূর্ব-ইতিহাস বিশেষ কিছু জানা যায় না। চতুর্দ্দশ পঞ্চদশ শতাব্দীর আরবী ঐতিহাসিক ই-ই হজর ও আল-সখাওয়ীর মতে ইলিয়াস শাহের আদি নিবাস ছিল পূর্ব ইরানের সিজিস্তানে। পরবর্তীকালে রচিত ইতিহাসগ্রন্থগুলির কোনোটিতে তাঁহাকে আলী শাহের ধাত্রীমাতার পুত্র, কোনোটিতে তাঁহার ভৃত্য বলা হইয়াছে।
লখনৌতি রাজ্যের অধীশ্বর হইবার পর ইলিয়াস রাজ্যবিস্তার ও অর্থসংগ্রহে মন দেন। প্রথমে সম্ভবত তিনি সাতগাঁও অঞ্চল অধিকার করেন। নেপালের সমসাময়িক শিলালিপি ও গ্রন্থাদি হইতে জানা যায় যে, ইলিয়াস নেপাল আক্রমণ করিয়া সেখানকার বহু নগর জ্বালাইয়া দেন এবং বহু মন্দির ধ্বংস করেন; বিখ্যাত পশুপতিনাথের মূর্ত্তিটি তিনি তিন খণ্ড করেন (১৩৫০ খ্রী)। ইলিয়াস রাজ্যবিস্তার করিবার জন্য নেপালে অভিযান করেন নাই, সেখানে ব্যাপকভাবে লুঠপাট করিয়া ধন সংগ্রহ করাই ছিল তাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য। ‘তবকাৎ-ই-আকবরী’ ও ‘তারিখ-ই ফিরিশতা’য় লেখা আছে, ইলিয়াস উড়িষ্যা আক্রমণ করিয়া চিল্কা হ্রদের সীমা পর্যন্ত অভিযান চালান এবং সেখানে ৪৪টি হাতি সমেত অনেক সম্পত্তি লুঠ করেন। বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ হইতে জানা যায় যে ইলিয়াস ত্রিহুত অধিকার করিয়াছিলেন; ষোড়শ শতাব্দীর ঐতিহাসিক মুল্লা তকিয়ার মতে ইলিয়াস হাজীপুর অবধি জয় করেন। সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’ নামে একটি সমসাময়িক গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, ইলিয়াস চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশী প্রভৃতি অঞ্চলও জয় করেন। পূর্বদিকেও ইলিয়াস রাজ্যবস্তিার করিয়াছিলেন। মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায় যে ইলিয়াস ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহের নিকট হইতে সোনারগাঁও অঞ্চল অধিকার করিয়া লইয়াছিলেন (১৩৫২ খ্রী)। কামরূপেরও অন্তত কতকাংশ ইলিয়াসের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল, কারণ তাঁহার পুত্র সিকন্দর শাহের রাজত্বের প্রথম বৎসরের একটি মুদ্রা কামরূপের টাকশালে উত্তীর্ণ হইয়াছিল।
এইভাবে ইলিয়াস শাহ নানা রাজ্য জয় করায় এবং পূর্বতন তুগলক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অনেক অঞ্চল অধিকার করায় দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুগলক ক্রুদ্ধ হন এবং ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। এই অভিযানের সময় ফিরোজ শাহ কর হ্রাস প্রভৃতির প্রলোভন দেখাইয়া ইলিয়াস শাহের প্রজাদের দলে টানিবার চেষ্টা করেন এবং তাহাতে আংশিক সাফল্য লাভ করেন। এই অভিযানের ফলে শেষপর্যন্ত ত্রিহুত প্রভৃতি নববিজিত অঞ্চলগুলি ইলিয়াসের হস্তচ্যুত হয়, কিন্তু বাংলায় তাঁহার সার্বভৌম অধিকার অক্ষুণ্ণই রহিয়া যায়।
জিয়াউদ্দীন বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’, শামস্-ই সিরাজ আফিফ-এর ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ এবং অজ্ঞাতনামা সমসাময়িক ব্যক্তির লেখা ‘সিরাৎ-ই ফিরোজ শাহী’ হইতে ফিরোজ শাহ ও ইলিয়াস শাহের সংঘর্ষের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। এই তিনটি গ্রন্থই ফিরোজ শাহের পক্ষভুক্ত লোকের লেখা বলিয়া ইহাদের মধ্যে একদেশদর্শিতা উৎকটরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। ইহাদের বিবরণের সারমর্ম এই।
ফিরোজ শাহ তাঁহার সিংহাসনে আরোহণের পরেই (১৩৫১ খ্রী) সংবাদ পান যে ইলিয়াস ত্রিহুত অধিকার করিয়া সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের উপর অত্যাচার ও লুঠতরাজ চালাইতেছে। ১৩৫৩ খ্রষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ ইলিয়াসকে দমন করিবার জন্য এক বিশাল বাহিনী লইয়া বাংলার দিকে যাত্রা করেন। অযোধ্যা প্রদেশ হইয়া তিনি ত্রিহুতে পৌঁছান এবং ত্রিহুত পুনরধিকার করেন। অতঃপর ফিরোজ শাহ বাংলাদেশে উপনীত হইয়া ইলিয়াসের রাজধানী পাণ্ডুয়া জয় করিয়া লন। ইলিয়াস তাঁহার পূর্বেই পাণ্ডুয়া হইতে তাঁহার লোকজন সরাইয়া লইয়া একডালা নামক একটি অনতিদূরবর্তী দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। এই একডালা যেমনই বিরাট, তেমনি দুর্ভেদ্য দুর্গ, ইহার চারিদিক নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল। ফিরোজ শাহ কিছুকাল একডালা দুর্গ অবরোধ করিয়া রহিলেন, কিন্তু ইলিয়াস আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণই দেখাইলেন না। অবশেষে একদিন ফিরোজ শাহের সৈন্যেরা এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাওয়ায় ইলিয়াস মনে করিলেন ফিরোজ শাহ পশ্চাদপসরণ করিতেছেন (ইহা বারনির বিবরণে লিখিত হইয়াছে, আফিফ ও ‘সিরাৎ’-এর বিবরণ এক্ষেত্রে ভিন্নরূপ), তখন তিনি একডালা দুর্গ হইতে সসৈন্যে বাহির হইয়া ফিরোজ শাহের বাহিনীকে আক্রমণ করিলেন। দুই পক্ষে যে যুদ্ধ হইল তাহাতে ইলিয়াস পরাজিত হইলেন, এবং ইহার পর তিনি আবার একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।
এতদূর পর্যন্ত এই তিনটি গ্রন্থের বিবরণের মধ্যে মোটামুটিভাবে ঐক্য আছে, কেবলমাত্র দুই একটি খুঁটিনাটি বিষয়ে পার্থক্য দেখা যায়; ইলিয়াস শাহ সম্বন্ধে বিদ্বেষমূলক উক্তিগুলি বাদ দিলে এই বিবরণ মোটের উপর নির্ভরযোগ্য। কিন্তু যুদ্ধের ধরন এবং পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে তিনটি গ্রন্থের উক্তিতে মিল নাই এবং তাহা বিশ্বাসযোগ্যও নহে। বারনির মতে এই যুদ্ধে ফিরোজ শাহের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হয়। নাই, ইলিয়াসের অসংখ্য সৈন্য মারা পড়িয়াছিল এবং ফিরোজ শাহ ৪৪টি হাতি সমেত ইলিয়াসের বহু সম্পত্তি হস্তগত করিয়াছিলেন; ইলিয়াসের পরাজয়ের পরে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ অধিকার করিবার প্রয়োজন বোধ করেন নাই, তিনি মনে করিয়াছিলেন যে ৪৪টি হাতি হারানোর ফলে ইলিয়াসের দম্ভ চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আফিফের মতে ইলিয়াস শাহের অন্তঃপুরের মহিলারা একডালা দুর্গের ছাদে দাঁড়াইয়া মাথার কাপড় খুলিয়া শোক প্রকাশ করায় ফিরোজ শাহ বিচলিত হইয়াছিলেন এবং মুসলমানদের নিধন ও মহিলাদের অমর্যাদা করিতে অনিচ্ছুক হইয়া একডালা দুর্গ অধিকারের পরিকল্পনা ত্যাগ করিয়াছিলেন; তিনি বাংলাদেশের বিজিত অঞ্চলগুলি স্থায়িভাবে নিজের অধিকারে রাখার ব্যবস্থাও করেন নাই, কারণ এ দেশ জলাভূমিতে পূর্ণ! ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’র মতে ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গের অধিবাসীদের, বিশেষত মহিলাদের করুণ আবেদনের ফলে একডালা দুর্গ অধিকারে ক্ষান্ত হইয়াছিলেন।