ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ লখনৌতি বেশিদিন নিজের অধিকারে রাখিতে পারেন। নাই বটে, কিন্তু সোনারগাঁও সমেত পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ বরাবরই তাঁহার অধীনে ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ঔরঙ্গজেবের অধীনস্থ কর্মচারী শিহাবুদ্দীন তালিশ লিখিয়াছিলেন যে ফখরুদ্দীন চট্টগ্রামও জয় করিয়াছিলেন এবং চাঁদপুর হইতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত তিনি একটি বাঁধ নির্মাণ করাইয়াছিলেন; চট্টগ্রামের বহু মসজিদ ও সমাধিও তাঁহারই আমলে নির্মিত হয়।
ইবন বতুতা ফখরুদ্দীনের রাজত্বকালে বাংলা দেশে আসিয়াছিলেন। তিনি গোলযোগের ভয়ে ফখরুদ্দীনের সহিত দেখা করেন নাই। ইবন্ বক্তৃতার ভ্রমণ বিবরণী হইতে ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে অনেক সংবাদ পাওয়া যায়। ইবন বতুতা লিখিয়াছেন যে, ফখরুদ্দীনের সহিত (আলাউদ্দীন) আলী শাহের প্রায়ই যুদ্ধ হইত। ফখরুদ্দীনের নৌবল বেশি শক্তিশালী ছিল, তাই তিনি বর্ষাকাল ও শীতকালে লখনৌতি আক্রমণ করিতেন, কিন্তু গ্রীষ্মকালে আলী শাহ ফখরুদ্দীনর রাজ্য আক্রমণ করিতেন, কারণ স্থলে তাঁহারই শক্তি বেশি ছিল। ফকীরদের প্রতি ফখরুদ্দীনের অপরিসীম দুর্বলতা ছিল। তিনি একবার শায়দা নামে একজন ফকীরকে তাঁহার অন্যতম রাজধানী সোদকাওয়াঙ’ অর্থাৎ চাটগাঁও শহরে তাঁহার প্রতিনিধি নিযুক্ত করিয়া জনৈক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়াছিলেন। বিশ্বাসঘাতক শায়দা সেই সুযোগে বিদ্রোহ করে এবং ফখরুদ্দীনের একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে। ফখরুদ্দীন তখন ‘চাটগাঁওয়ে’ ফিরিয়া আসেন। শায়দা তখন সোনারগাঁও-এ পলাইয়া যায় এবং ঐ স্থান অধিকার করিয়া বসিয়া থাকে, কিন্তু সোনারগাঁওয়ের অধিবাসীরা তাহাকে বন্দী করিয়া সুলতানের বাহিনীর কাছে পাঠাইয়া দেয়। তখন শায়দা ও অন্য অনেক ফকীরের প্রাণদণ্ড হইল। ইহার পরেও কিন্তু ফখরুদ্দীনের ফকীরদের প্রতি দুর্বলতা কমে নাই। তাঁহার আদেশের বলে ফকীররা মেঘনা নদী দিয়া বিনা ভাড়ায় নৌকায় যাতায়াত করিতে পারিত; নিঃসম্বল ফকীরদের খাদ্যও দেওয়া হইত। সোনারগাঁও শহরে কোনো ফকীর আসিলে সে আধ দীনার (আট আনার মতো) পাইত।
ইবন বতুতার বিবরণ হইতে জানা যায় যে ফখরুদ্দীনের আমলে বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব সুলভ ছিল। ফখরুদ্দীন কিন্তু হিন্দুদের প্রতি খুব ভালো ব্যবহার করেন নাই। ইবন বতুতা হব’ শহরে (আধুনিক শ্রীহট্ট জেলার অন্ত ভুক্ত) গিয়া দেখিয়াছিলেন যে সেখানকার হিন্দুরা তাহাদের উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক সরকারকে দিতে বাধ্য হইত এবং ইহা ব্যতীত তাহাদের আরো নানারকম কর দিতে হইত।
কয়েকখানি ইতিহাসগ্রন্থের মতে ফখরুদ্দীন শক্রর হাতে নিহত হইয়া পরলোকগমন করিয়াছিলেন। কিন্তু কাহার হাতে তিনি নিহত হইয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে বিভিন্ন বিবরণের উক্তির মধ্যে ঐক্য নাই এবং এই-সব বিবরণের মধ্যে যথেষ্ট ভুলও ধরা পড়িয়াছে। ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে যে-সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তাঁহার ভিত্তিতে নিঃসংশয়ে বলা যায় যে ফখরুদ্দীন ১৩৩৮ হইতে ১৩৫০ খ্রী পর্যন্ত রাজত্ব করিয়া স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন।
ফখরুদ্দীন সম্বন্ধে আর-একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে তাঁহার মুদ্রাগুলি অত্যন্ত সুন্দর, বাংলাদেশে প্রাপ্ত সমস্ত মুদ্রার মধ্যে এইগুলিই শ্রেষ্ঠ।
২
ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ
ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের ঠিক পরেই ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ নামে এক ব্যক্তি পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করিয়াছিলেন (১৩৪৯-১৩৫২ খ্রী)। ইখতিয়ারুদ্দীনের সোনারগাঁও এর টাকশালে উৎকীর্ণ অনেকগুলি মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। এই মুদ্রাগুলি হুবহু ফখরুদ্দীনের মুদ্রার অনুরূপ। এইসব মুদ্রায় ইখতিয়ারুদ্দীনকে “সুলতানের পুত্র সুলতান” বলা হইয়াছে। সুতরাং ইখতিয়ারুদ্দীন যে ফখরুদ্দীনেরই পুত্র, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। ইতিহাসগ্রন্থগুলিতে এই ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহের নাম পাওয়া যায় না, তবে ‘মলফুজুস-সফর’ নামে একটি সমসাময়িক সূফীগ্রন্থে ইহার নাম উল্লিখিত হইয়াছে।
৭৫৩ হিজরায় (১৩৫২-৫৩ খ্রী) শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও অধিকার করেন। কোনো কোনো ইতিহাসগ্রন্থের মতে তিনি ফখরুদ্দীনকে এই সময়ে বধ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা সত্য হইতে পারে না, কারণ ফখরুদ্দীন ইহার তিন বৎসর পূর্বেই পরলোকগমন করিয়াছিলেন। সম্ভবত ইখতিয়ারুদ্দীনই ইলিয়াস শাহের হাতে নিহত হন।
৩
আলাউদ্দীন আলী শাহ
আলাউদ্দীন আলী শাহ কীভাবে লখনৌতির রাজা হইয়াছিলেন, তাহা ইতিপূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।
ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের সহিত আলী শাহের প্রায়ই সংঘর্ষ হইত। এ সম্বন্ধেও পূর্বে আলোচনা করা হইয়াছে।
আলী শাহ সম্ভবত লখনৌতি অঞ্চল ভিন্ন আর-কোনো অঞ্চল অধিকার করিতে পারেন নাই। তাঁহার সমস্ত মুদ্রাই পাণ্ডুয়া বা ফিরোজাবাদের টাকশালে নির্মিত হইয়াছিল। যতদূর মনে হয় তিনি গৌড় বা লখনৌতি হইতে পাণ্ডুয়ায় তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। ইহার পর প্রায় একশত বৎসর পাণ্ডুয়াই বাংলার রাজধানী ছিল। আলাউদ্দীন আলী শাহ ৭৪২ হিজরায় (১৩৪১ ৪২ খ্রী) সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং মাত্র এক বৎসর কয়েক মাস রাজত্ব করিয়া পরলোক গমন করেন। মালিক ইলিয়াস হাজী নামে তাঁহার অধীনস্থ এক ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করিয়া তাহাকে বধ করেন এবং শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নাম গ্রহণ করিয়া নিজে সুলতান হন।