গিয়াসুদ্দীন তুগলক বাংলা দেশ হইতে লুণ্ঠিত বহু ধনরত্ন এবং বন্দী গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরকে লইয়া দিল্লির দিকে রওনা হইলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি দিল্লিতে পৌঁছিতে পারেন নাই। তাঁহার পুত্র জুনা খান দিল্লির উপকণ্ঠে তাঁহার অভ্যর্থনার জন্য যে মণ্ডপ নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাহাতে প্রবেশ করিবামাত্র তাহা ভাঙিয়া পড়িল এবং ইহাতেই তাঁহার প্রাণান্ত হইল (১৩২৫ খ্রী)।
ইহার পর জুনা খান মুহম্মদ শাহ নাম লইয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। ইতিহাসে তিনি মুহম্মদ তুগলক নামে পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করিলেন। লখনৌতি অঞ্চলের শাসনভার কেবলমাত্র নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম শাহের অধীনে না রাখিয়া তিনি পিণ্ডার খিলজী নামে এক ব্যক্তিকে নাসিরুদ্দীনের সহযোগী শাসনকর্ত্তা রূপে নিয়োগ করিয়া দিল্লি হইতে পাঠাইয়া দিলেন এবং পিণ্ডারকে ‘কদর খান’ উপাধি দিলেন; মালিক আবু রেজাকে তিনি লখনৌতির উজীরের পদে নিয়োগ করিলেন। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহকেও তিনি মুক্তি দিলেন এবং তাঁহাকে সোনারগাঁওয়ে তাতার খানের সহযোগী শাসকর্ত্তারূপে নিয়োগ করিয়া পাঠাইলেন; ইতিপূর্বে তিনি তাঁহার অভিষেকের সময়ে তাতার খানকে ‘বহরাম খান’ উপাধি দিয়াছিলেন। মালিক ইজুদ্দীন য়াহিয়াকে তিনি সাতগাঁওয়ের শাসনকর্ত্তার পদে নিয়োগ করিলেন।
ইহার দুই বৎসর পর যখন মুহম্মদ তুগলক কিসলু খানের বিদ্রোহ দমন করিতে মুলতানে গেলেন (৭২৮ হি = ১৩২৭-২৮ খ্রী), তখন লখনৌতি হইতে নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম গিয়া তাঁহার সহিত যোগদান করিলেন এবং কিসলু খানের সহিত যুদ্ধে দক্ষতার পরিচয় দিলেন। ইহার পর নাসিরুদ্দীনের কী হইল, সে সম্বন্ধ কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না।
গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ ১৩২৫ খ্রী হইতে ১৩২৮ খ্রী পর্যন্ত বহরম খানের সঙ্গে যুক্তভাবে সোনারগাঁও অঞ্চল শাসন করেন। এই কয় বৎসর তিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ করেন; সেই-সব মুদ্রায় যথারীতি সম্রাট হিসাবে মুহম্মদ তুগলকের নামও উল্লিখিত থাকিত। অতঃপর মুহম্মদ তুগলক যখন মুলতানে কিসলু খানের বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন, তখন গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর সুযোগ বুঝিয়া বিদ্রোহ করিলেন। কিন্তু বহরাম খানের তৎপরতার দরুন তিনি বিশেষ কিছু করিবার সুযোগ পাইলেন না। বহরাম খান গিয়াসুদ্দীনের বিদ্রোহের সংবাদ পাইবামাত্র সমস্ত সেনানায়ককে একত্র করিলেন এবং এই সম্মিলিত বাহিনী লইয়া গিয়াসুদ্দীনকে আক্রমণ করিলেন। তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়া গিয়াসুদ্দীন পরাজিত হইলেন এই যমুনা নদীর দিকে পলাইতে লাগিলেন। কিন্তু বহরাম খান তাঁহার সৈন্যবাহিনীকে পিছন হইতে আক্রমণ করিলেন। গিয়াসুদ্দীনের বহু সৈন্য নদী পার হইতে গিয়া জলে ডুবিয়া গেল। গিয়াসুদ্দীন স্বয়ং বহরাম খানের হাতে বন্দী হইলেন। বহরাম খান তাঁহাকে বধ করিয়া তাঁহার গাত্রচর্ম ছাড়াইয়া লইয়া মুহম্মদ তুগলকের কাছে পাঠাইয়া দিলেন। মুহম্মদ তুগলক সমস্ত সংবাদ শুনিয়া সকলকে চল্লিশ দিন উৎসব করিতে আদেশ দিলেন এবং গিয়াসুদ্দীন ও মুলতানের বিদ্রোহীর গাত্রচর্ম বিজয়-গম্বুজে টাঙাইয়া রাখিতে আদেশ দিলেন।
ইহার পর দশ বৎসর কদর খান, বহরাম খান ও মালিক ইজুদ্দীন য়াহিয়া মুহম্মদ তুগলকের অধীনস্থ শাসনকর্ত্তা হিসাবে যথাক্রমে লখনৌতি, সোনারগাঁও ও সাতগাঁও অঞ্চল শাসন করেন। এই দশ বৎসরের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে নাই। ১৩৩৮ খ্রীষ্টাব্দে বহরম খান পরলোক গমন করিবার পর তাঁহার বৰ্মরক্ষক ফখরুদ্দীন সোনারগাঁওয়ে বিদ্রোহ করিলেন। এই ঘটনা হইতেই বাংলার ইতিহাসের একটি নূতন অধ্যায় সুরু হইল।
০৩. বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ–ইলিয়াস শাহী বংশ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ–ইলিয়াস শাহী বংশ
১
ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ
জিয়াউদ্দীন বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ গ্রন্থে ফখরুদ্দীনের বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। ইহার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় কিঞ্চিৎ পরবর্তীকালে রচিত ‘তারিখ-ই-মুবারক শাহী’ হইতে।
এই বিবরণ নির্ভরযোগ্য। এই গ্রন্থের মতে বহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁহার বর্ম্মরক্ষক ফখরুদ্দীন সোনারগাঁও অধিকার করিয়া নিজেকে স্বাধীন নৃপতি বলিয়া ঘোষণা করিলে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা কদর খান, সাতগাঁওয়ের শাসনকর্ত্তা ইজুদ্দীন য়াহিয়া এবং সম্রাটের অধীনস্থ অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা তাঁহাকে দমন করিবার জন্য যুদ্ধযাত্রা করেন। তাঁহাদের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া ফখরুদ্দীন পলায়ন করেন। তাঁহার হাতি ও ঘোড়াগুলি কদর খানের অধীনে আসে। কদর খান লুঠ করিয়া অনেক রৌপ্যমুদ্রাও হস্তগত করেন। মালিক হিসামুদ্দীন নামে জনৈক পদস্থ অমাত্য কদর খানকে এই অর্থ রাজকোষে পাঠাইয়া দিতে বলিলেন। কিন্তু কদর খান তাহা করিলেন না। তিনি সৈন্যদের এই লুঠের কোনো ভাগও দিলেন না। ইহাতে সৈন্যেরা তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইল এবং তাহারা ফখরুদ্দীনের সঙ্গে যোগ দিয়া কদর খানকে হত্যা করিল। ফখরুদ্দীন সোনারগাঁও পুনরধিকার করিলেন। লখনৌতিও তিনি সাময়িকভাবে অধিকার করিলেন এবং মুখলিশ নামে এক ব্যক্তিকে ঐ অঞ্চলে শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু কদর খানের অধীনস্থ আরিজ-ই-লস্কর (সৈন্যবাহিনীর বেতন-দাতা) আলী মুবারক মুখলিশকে বধ করিয়া লখনৌতি অধিকার করিলেন। তিনি মুহম্মদ তুগলককে লখনৌতিতে একজন শাসনকর্ত্তা পাঠাইতে অনুরোধ জানাইলেন। মুহম্মদ তুগলক দিল্লির শাসনকর্ত্তা য়ুসুফকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু লখনৌতিতে পৌঁছিবার পূর্বেই য়ুসুফ পরলোকগমন করিলেন। মুহম্মদ তুগলক আর কাহাকেও তাঁহার জায়গায় নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন না। এদিকে লখনৌতিতে কোনো শাসনকর্ত্তা না থাকায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছিল। ইহার জন্য ফখরুদ্দীনের আক্রমণ রোধ করাও কঠিন হইয়া পড়িয়াছিল। তাই আলী মুবারক বাধ্য হইয়া আলাউদ্দীন (আলাউদ্দীন আলী শাহ) নাম গ্রহণ করিয়া নিজেকে লখনৌতির নৃপতি বলিয়া ঘোষণা করিলেন।