শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের অন্তত ছয়টি বয়ঃপ্রাপ্ত পুত্র ছিলেন বলিয়া জানা যায়। ইঁহাদের নাম-শিহাবুদ্দীন বুগড়া শাহ, জলালুদ্দীন মাহমুদ শাহ, গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ, নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম শাহ, হাতেম খান ও কলু খান। ইঁহাদের মধ্যে হাতেম খান পিতার রাজত্বকালে বিহার অঞ্চলের শাসনকর্ত্তা ছিলেন বলিয়া শিলালিপি হইতে জানা যায়। শিহাবুদ্দীন, জলালুদ্দীন, গিয়াসুদ্দীন ও নাসিরুদ্দীন পিতার জীবদ্দশাতেই বিভিন্ন টাকশাল হইতে নিজেদের নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইহা হইতে কেহ কেহ মনে করিয়াছেন যে ইঁহারা পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন। কিন্তু এই মত যে ভ্রান্ত, তাহা মুদ্রার সাক্ষ্য এবং বিহারের সমসাময়িক দরবেশ হাজী আহমদ য়াহয়া মনেরির মলফুজৎ’ (আলাপ-আলোচনার সগ্রহ)-এর সাক্ষ্য হইতে প্রতিপন্ন হয়। প্রকৃত সত্য এই যে, শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ তাঁহার ঐ চারিজন পুত্রকেও রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে শাসনকর্ত্তার পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের নিজ গ্রামে মুদ্রা প্রকাশের অধিকার দিয়াছিলেন।
আহমদ য়াহয়া মনেরির ‘মলফুজৎ’-এর মতে ‘কামরু’ (কামরূপ)-ও শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল এবং তাঁহার শাসনকর্ত্তা ছিলেন গিয়াসুদ্দীন। এই মলফুজৎ হইতে জানা যায় যে গিয়াসুদ্দীন অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ধত প্রকৃতির এবং হাতেম খান একান্ত মৃদু ও উদার প্রকৃতির লোক ছিলেন। ‘মলফুজৎ’-এর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করিলে মনে হয়, শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের রাজধানী ছিল সোনারগাঁওয়ে।
চর্তুদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ হইতেই বাংলার সুলতানের মুদ্রায় পাণ্ডুয়া (মালদহ জেলা) নগরের নামান্তর ‘ফিরোজাবাদ’-এর উল্লেখ দেখা যায়। সম্ভবত শামসুদ্দীন ফিরোজশাহের নাম অনুসারেই নগরীটির এই নাম রাখা হইয়াছিল।
৫
বাহাদুর শাহ ও নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম শাহ
শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে তিনজন সমসাময়িক লেখকের বিবরণ পাওয়া যায়। ইঁহারা হইলেন জিয়াউদ্দীন বারনি, ইসমি এবং ইবনবতা। এই তিনজন লেখকের উক্তি এবং মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে যাহা জানা যায়, তাঁহার সংক্ষিপ্তসার নীচে প্রদত্ত হইল।
শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র শিহাবুদ্দীন বুগড়া শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। কিন্তু তাঁহার ভ্রাতা গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ শিহাবুদ্দীনকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া লখনৌতি অধিকার করিলেন। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরের হাতে শিহাবুদ্দীন বুগড়া ও নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম ব্যতীত তাঁহার আর সমস্ত ভ্রাতাই নিহত হইলেন। শিহাবুদ্দীন ও নাসিরুদ্দীন দিল্লির তৎকালীন সুলতান গিয়াসুদ্দীন তুগলকের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। শিহাবুদ্দীন বুগড়া সম্ভবত সাহায্য প্রার্থনা করার অব্যবহিত পরেই পরলোকগমন করিয়াছিলেন, কারণ ইহার পরে তাঁহার আর কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না। বারনি লিখিয়াছেন যে লখনৌতির কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া গিয়াসুদ্দীন তুগলকের সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দীন তুগলক এই সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিলেন এবং তাঁহার পুত্র জুনা খানের উপর দিল্লির শাসনভার অর্পণ করিয়া পূর্ব ভারত অভিমুখে সসৈন্যে যাত্রা করিলেন (জানুয়ারি, ১৩২৪ খ্রী)। প্রথমে তিনি ত্রিহুত আক্রমণ করিলেন এবং সেখানকার কর্ণাট-বংশীয় রাজা হরিসিংহদেবকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া ঐ রাজ্যে প্রথম মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা করিলেন। ত্রিহুতে নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিত তাঁহার সহিত যোগদান করিলেন। গিয়াসুদ্দীন তুগলক তাঁহার পালিত পুত্র তাতার খানের অধীনে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নাসিরুদ্দীনের সঙ্গে দিলেন। এই বাহিনী লখনৌতি অধিকার করিয়া লইল।
গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ ইতিমধ্যে লখনৌতি হইতে পূর্ববঙ্গে পলাইয়া গিয়াছিলেন এবং গিয়াসপুর (বর্তমান ময়মনসিংহ শহরের ২৫ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে) অবস্থান করিতেছিলেন। শত্রুবাহিনীর অগ্রগতির খবর পাইয়া তিনি ঐ ঘাঁটি হইতে বাহির হইয়া লখনৌতির দিকে অগ্রসর হইলেন।
অতঃপর দুই পক্ষে যুদ্ধ হইল। ইসমি এই যুদ্ধের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়াছেন। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর প্রচণ্ড আক্রোশে তাঁহার ভ্রাতা নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম-পরিচালিত শত্রুবাহিনীর বাম অংশে আক্রমণ চালাইতে লাগিলেন। তাঁহার আক্রমণের মুখে দিল্লির সৈন্যেরা প্রথম প্রথম ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িতে লাগিল, কিন্তু সংখ্যাধিক্যের বলে তাহারা শেষপর্যন্ত জয়ী হইল। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর তখন পূর্ববঙ্গের দিকে পলায়ন করিলেন। হয়বউল্লার নেতৃত্বে দিল্লির একদল সৈন্য তাঁহার অনুসরণ করিল। অবশেষে গিয়াসুদ্দীনের ঘোড়া একটি নদী পার হইতে গিয়া কাদায় পড়িয়া গেলে দিল্লির সৈন্যেরা তাহাকে বন্দী করিল। . গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরকে তখন লখনৌতিতে লইয়া যাওয়া হইল এবং সেখানে দড়ি বাঁধিয়া তাঁহাকে গিয়াসুদ্দীন তুগলকের সভায় উপস্থিত করা হইল।
গিয়াসুদ্দীন তুগলক বাংলাকে তাঁহার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিমকে লখনৌতি অঞ্চলের শাসনভার অর্পণ করিলেন; তাতার খান সোনারগাঁও ও সাতগাঁওয়ের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইলেন। নাসিরুদ্দীনের নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতে সার্বভৌম সম্রাট হিসাবে প্রথমে গিয়াসুদ্দীন তুগলকের এবং পরে মুহম্মদ তুগলকের নাম থাকিত।