দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করিবার পথে কাইকোবাদ মাত্র কয়েকদিন ভালোভাবে চলিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার পর আবার তিনি উচ্ছঙ্খল হইয়া উঠেন। তাঁহার প্রধান সেনাপতি জলালুদ্দীন খিলজী তাঁহাকে হত্যা করান (১২৯০ খ্রী)। ইহার তিনমাস পরে জলালুদ্দীন কাইকোবাদের শিশুপুত্র কাইমুকে অপসারিত করিয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইহার পর বৎসর হইতে বাংলার সিংহাসনে বুগরা খানের দ্বিতীয় পুত্র রুকনুদ্দীন কাইকাউসকে অধিষ্ঠিত দেখিতে পাই। কাইকোবাদের মৃত্যুজনিত শোকই বুগরা খানের সিংহাসন ত্যাগের কারণ বলিয়া মনে হয়।
৩
রুকনুদ্দীন কাইকাউস
মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায়, রুকনুদ্দীন কাইকাউস ৬৯০ হইতে ৬৯৮ হি বা ১২৯১ হইতে ১২৯৮-৯৯ খ্রী পর্যন্ত লখনৌতির সুলতান ছিলেন। তাঁহার রাজত্বকালে বিশেষ কোনো ঘটনার কথা জানা যায় নাই।
কাইকাউসের প্রথম বৎসরের একটি মুদ্রায় লেখা আছে যে ইহা ‘বঙ্গ’-এর ভূমি-রাজস্ব হইতে প্রস্তুত হইয়াছে। সুতরাং পূর্ববঙ্গের কিছু অংশ যে কাইকাউসের রাজ্যভুক্ত ছিল, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। এই অংশ ১২৯১ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই মুসলমানগণ কর্ত্তৃক বিজিত হইয়াছিল। পশ্চিমবঙ্গের ত্রিবেণী অঞ্চলও কাইকাউসের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্ভবত এই অঞ্চল কাইকাউসের রাজত্বকালেই প্রথম বিজিত হয়, কারণ প্রাচীন প্রবাদ অনুসারে জাফর খান নামে একজন বীর মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ত্রিবেণী জয় করিয়াছিলেন। কাইকাউসের অধীনস্থ রাজপুরুষ এক জাফর খানের নামাঙ্কিত দুইটি শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে, তন্মধ্যে একটি শিলালিপি ত্রিবেণীতেই মিলিয়াছে। ইহা হইতে মনে হয়, এই জাফর খানই কাইকাউসের রাজত্বকালে ত্রিবেণী জয় করেন। বিহারেও কাইকাউসের অধিকার ছিল, এই প্রদেশের শাসনকর্ত্তা ছিলেন খান ইখতিয়ারুদ্দীন ফিরোজ আতিগীন নামে একজন প্রভাবপ্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি।
কাইকাউসের সহিত প্রতিবেশী রাজ্যগুলির কী রকম সম্পর্ক ছিল, সে সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। তবে দিল্লির খিলজী সুলতানদের বাংলার উপর একটা আক্রোশ ছিল। জলালুদ্দীন খিলজী মুসলিম ঠগীদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত না করিয়া নৌকায় বোঝাই করিয়া বাংলা দেশে পাঠাইয়া দিতেন, যাহাতে উহারা বাংলা দেশে লুঠতরাজ চালাইয়া এদেশের শাসক ও জনসাধারণকে অস্থির করিয়া তুলে।
৪
শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ
রুকনুদ্দীন কাইকাউসের পর শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ লখনৌতির সুলতান হন। ৭০১ হইতে ৭২২ হি বা ১৩০১ হইতে ১৩২২ খ্রী–এই সুদীর্ঘ একুশ বৎসর কাল তিনি রাজত্ব করেন। তাঁহার রাজ্যের আয়তন ছিল বিরাট। তাঁহার পূর্ববর্তী লখনৌতির সুলতানরা যে রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন, তাঁহার অতিরিক্ত বহু অঞ্চল –সাতগাঁও, ময়মনসিংহ ও সোনারগাঁও, এমন-কি সুদূর সিলেট পর্যন্ত তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। ইনি অত্যন্ত পরাক্রান্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন নরপতি ছিলেন, কিন্তু ইহার সম্বন্ধে খুব কম তথ্যই জানা যায়। ইহার বংশপরিচয়ও আমাদের অজ্ঞাত। ইন্বতার মতে ইনি বুগরা খানের পুত্র। কিন্তু মুদ্রার সাক্ষ্য এবং অন্যান্য প্রমাণ দ্বারা ইবুবক্তৃতার মত ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। যতদূর মনে হয় রুকনুদ্দীন কাইকাউসের আমলে যিনি বিহারের শাসনকর্ত্তা ছিলেন, সেই ইখতিয়ারুদ্দীন ফিরোজ আতিগীনই কাইকাউসের মৃত্যুর পরে শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ নাম লইয়া সুলতান হন। ইতিপূর্বে বলবন বুগরা খানকে সাহায্য করিবার জন্য “ফিরোজ” নামক দুইজন যোগ্য ব্যক্তিকে বাংলা দেশে রাখিয়া গিয়াছিলেন। তন্মধ্যে একজন ফিরোজকে বুগরা খান কাইকোবাদের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন; অপরজন বাংলাতেই ছিলেন, ইনিও আমাদের আলোচ্য শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের সহিত অভিন্ন হইতে পারেন।
শিলালিপির সাক্ষ্যের সহিত প্রাচীন কিংবদন্তীর সাক্ষ্য মিলাইয়া লইলে দেখা যায়, শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলেই সর্বপ্রথম সাতগাঁও মুসলিম শক্তি কর্ত্তৃক বিজিত হয়; এই বিজয়ে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব করেন ত্রিবেণী-বিজেতা জাফর খান; এই জাফর খান অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন, শিলালিপিতে ইনি “রাজা ও সম্রাটদের সাহায্যকারী” বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন; ত্রিবেণী ও সাতগাঁও বিজয়ের পরে জাফর খান এই অঞ্চলেই পরলোকগমন করেন; ত্রিবেণীতে তাঁহার সমাধি আছে।
শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে জানা যায়, শ্রীহট্ট বা সিলেটও শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের রাজত্বকালেই প্রথম বিজিত হইয়াছিল এবং সিলেট-বিজয়ের ব্যাপারে শেষ জলাল মুজাররদ কুন্যায়ী (কুন্যার অধিবাসী) নামে একজন দরবেশ বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। শাহ জলাল নামে একজন দরবেশ মুসলমানদের সিলেট অভিযানে নেতৃত্ব করিয়াছিলেন বলিযা প্রাচীন প্রবাদও আছে। এই শেখ জলাল বা শাহ জলাল বিখ্যাত দরবেশ শেখ জালালুদ্দিন তব্রিজী (১২৯৭-১৩৪৭ খ্রী) হইতে ভিন্ন ব্যক্তি।
কিংবদন্তী অনুসারে সাতগাঁও ও সিলেটের শেষ হিন্দু রাজাদের নাম যথাক্রমে ভূদেব নৃপতি ও গৌড়গোবিন্দ; উভয়েই নাকি গোবধ করার জন্য মুসলিম প্রজাদের পীড়ন করিয়াছিলেন এবং সেই কারণে মুসলমানরা তাহাদের রাজ্য আক্রমণ ও অধিকার করিয়াছিল। এই-সব কিংবদন্তীর বিশেষ কোনো ভিত্তি আছে বলিয়া মনে হয় না।