ইহার অল্প পরেই বলবন পরলোকগমন করিলেন (১২৮৭ খ্রী)। মৃত্যুকালে তিনি তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্রের পুত্র কাইখসরুকে আপনার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার উজীর ও কোতোয়ালের সহিত কাইখসরুর পিতার বিরোধ ছিল, এইজন্য তাঁহারা কাইখসরুকে দিল্লির সিংহাসনে না বসাইয়া বুগরা খানের পুত্র কাইকোবাদকে বসাইলেন। এদিকে লখনৌতিতে বুগরা খান স্বাধীন হইলেন এবং নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ ও খুত্বা পাঠ করাইতে সুরু করিলেন।
কাইকোবাদ তাঁহার পিতার চেয়েও বিলাসী ও উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি সুলতান হইবার পরে দিল্লির সন্নিকটে কীলোখারী নামক স্থানে একটি নূতন প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া চরম উজ্জ্বলতায় মগ্ন হইয়া গেলেন। মালিক নিজামুদ্দীন এবং মালিক কিওয়ামুদ্দীন নামে দুই ব্যক্তি তাঁহার প্রিয়পাত্র ছিল, ইহাদের প্রথমজন প্রধান বিচারপতি ও রাজপ্রতিনিধি এবং দ্বিতীয়জন সহকারী রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত হইল এবং ইহারাই রাজ্যের সর্বময় কর্ত্তা হইয়া দাঁড়াইল। ইহাদের কুমন্ত্রণায় কাইকোবাদ কাইখসরুকে নিহত করাইলেন, পুরাতন উজীরকে অপমান করিলেন এবং বলবনের আমলের কর্মচারীদের সকলকেই একে একে নিহত বা পদচ্যুত করিলেন।
কাইকোবাদ যে এইরূপে সর্বনাশের পথে অগ্রসর হইয়া চলিতেছেন, এই সংবাদ লখনৌতিতে বুগরা খানের কাছে পৌঁছিল। তিনি তখন পুত্রকে অনেক সদুপদেশ দিয়া পত্র লিখিলেন। কিন্তু কাইকোবাদ ( বোধ হয় পিতার “উপযুক্ত পুত্র” বলিয়াই) পিতার উপদেশ কর্ণপাত করিলেন না। বুগরা খান যখন দেখিলেন যে পত্র লিখিয়া কোনো লাভ নাই, তখন তিনি স্থির করিলেন দিল্লির সিংহাসন অধিকার করার চেষ্টা করিবেন এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি এক সৈন্যবাহিনী লইয়া অগ্রসর হইলেন।
পিতা সসৈন্যে দিল্লিতে আসিতেছেন শুনিয়া কাইকোবাদ তাঁহার প্রিয়পাত্র নিজামুদ্দীনের সহিত পরামর্শ করিলেন এবং তাঁহার পরামর্শ অনুযায়ী এক সৈন্যবাহিনী লইয়া বাংলার দিকে অগ্রসর হইলেন। সরযূ নদীর তীরে যখন তিনি পৌঁছিলেন তখন বুগরা খান সরযূর অপর পারে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।
ইহার পর দুই-তিন দিন উভয় বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হইয়া রহিল। কিন্তু যুদ্ধ হইল না। তাঁহার বদলে সন্ধির কথাবার্তা চলিতে লাগিল। সন্ধির শর্ত স্থির হইলে বুগরা খান তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র কাইকাউসকে উপঢৌকন সমেত কাইকোবাদের দরবারে পাঠাইলেন। কাইকোবাদও পিতার কাছে নিজের শিশুপুত্র কাইমুরকে একজন উজীরের সঙ্গে উপহারসমেত পাঠাইলেন। পৌত্রকে দেখিয়া বুগরা খান সমস্ত কিছু ভুলিয়া গেলেন এবং দিল্লির উজীরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া তাহাকে আদর করিতে লাগিলেন।
দুষ্ট নিজামুদ্দীনের পরামর্শে কাইকোবাদ এই শর্তে বুগরা খানের সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন যে বুগরা খান কাইকোবাদের সভায় সাধারণ প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তার মতোই তাঁহাকে অভিবাদন করিবেন ও সম্মান দেখাইবেন। অনেক আলাপ আলোচনা ও ভীতিপ্রদর্শনের পরে বুগরা খান এই শর্তে রাজী হইয়াছিলেন। এই শর্ত পালনের জন্য বুগরা খান একদিন বৈকালে সরযূ নদী পার হইয়া কাইকোবাদের শিবিরে গেলেন। কাইকোবাদ তখন সম্রাটের উচ্চ মসনদে বসিয়াছিলেন। কিন্তু পিতাকে দেখিয়া তিনি আর থাকিতে পারিলেন না। তিনি খালি পায়েই তাঁহার পিতার কাছে দৌড়াইয়া গেলেন এবং তাঁহার পায়ে পড়িবার উপক্রম করিলেন। বুগরা খান তখন কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন। কাইকোবাদ পিতাকে মসনদে বসিতে বলিলেন, কিন্তু বুগরা খান তাহাতে রাজী না হইয়া পুত্রকে লইয়া গিয়া মসনদে বসাইয়া দিলেন এবং নিজে মসনদের সামনে করজোড়ে দাঁড়াইয়া রহিলেন। এইভাবে বুগরা খান “ম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার পর কাইকোবাদ মসনদ হইতে নামিয়া আসিলেন। তখন সভায় উপস্থিত আমীরেরা দুই বাদশাহের শির স্বর্ণ ও রত্নে ভূষিত করিয়া দিলেন। শিবিরের বাহিরে উপস্থিত লোকেরা শিবিরের মধ্যে আসিয়া দুইজনকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে লাগিল, কবিরা বাদশাহদ্বয়ের প্রশস্তি করিতে লাগিলেন, এক কথায় পিতাপুত্রের মিলনে কাইকোবাদের শিবিরে মহোৎসব উপস্থিত হইল। তাঁহার পর বুগরা খান নিজের শিবিরে ফিরিয়া আসিলেন।
ইহার পরেও কয়েকদিন বুগরা খান ও কাইকোবাদ সরযূ নদীর তীরেই রহিয়া গেলেন। এই কয়দিনও পিতাপুত্রে সাক্ষাৎকার ও উপহারবিনিময় চলিয়াছিল। বিদায়গ্রহণের পূর্বাহে বুগরা খান কাইকোবাদকে প্রকাশ্যে অনেক সদুপদেশ দিলেন, সংযমী হইতে বলিলেন এবং মালিক নিজামুদ্দীন ও কিওয়ামুদ্দীনকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ করিতে পরামর্শ দিলেন, কিন্তু বিদায় লইবার সময় কাইকোবাদের কানে কানে বলিলেন যে, তিনি যেন এই দুইজন আমীরকে প্রথম সুযোগ পাইবামাত্র বধ করেন। ইহার পর দুই সুলতান নিজের নিজের রাজধানীতে ফিরিয়া গেলেন।
বিখ্যাত কবি আমীর খসরু কাইকোবাদের সভাকবি ছিলেন এবং এই অভিযানে তিনি কাইকোবাদের সঙ্গে গিয়াছিলেন। কাইকোবাদের নির্দেশে তিনি বুগরা খান ও কাইকোবাদের এই মধুর মিলন অবিকলভাবে বর্ণনা করিয়া ‘কিরান-ই-সদাইন’ নামে একটি কাব্য লিখেন। সেই কাব্য হইতেই উপরের বিবরণ সংকলিত হইয়াছে।
কাইকোবাদের সঙ্গে সন্ধি হইবার পরে বুগরা খান-আউধের যে অংশ তিনি অধিকার করিয়াছিলেন, তাহা কাইকোবাদকে ফিরাইয়া দেন। কিন্তু বিহার তিনি নিজের দখলেই রাখিলেন।