রায় দনুজ অত্যন্ত পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। তিনি বলবনের শিবিরে গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন এই শর্তে যে তিনি বলবনের সভায় প্রবেশ করিলে বলবন উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহাকে সম্মান দেখাইবেন। বলবন এই শর্ত পালন করিয়াছিলেন।
যাহা হউক, বলবনের সহিত আলোচনার পর রায় দনুজ কথা দিলেন যে তুগরল যদি তাঁহার অধিকারের মধ্যে জলে বা স্থলে অবস্থান করেন অথবা জলপথে পলাইতে চেষ্টা করেন, তাহা হইলে তিনি তাঁহাকে আটকাইবেন। ইহার পর বলবন ৭০ ক্রোশ চলিয়া জাজনগর রাজ্যের সীমান্তের খানিকটা দূরে পৌঁছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক বারনির এই উক্তিকেও ভুল মনে করিয়াছেন, কিন্তু তখনকার ‘সোনারগাঁও রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত হইতে ‘জাজনগর’ রাজ্যের পূর্ব সীমান্তের দূরত্ব কোনো কোনো জায়গায় কিঞ্চিদূর্ধ্ব ৭০ ক্রোশ (১৪০ মাইল) হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।
জাজনগরের সীমার কাছাকাছি উপস্থিত হইয়া বলবন তুগরলের কোনো সংবাদ পাইলেন না, তিনি অন্য পথে গিয়াছিলেন। বলবন মালিক বেক্তকে সাত-আট হাজার ঘোড়সওয়ার সৈন্য দিয়া আগে পাঠাইয়া দিলেন। বেতর চারিদিকে গুপ্তচর পাঠাইয়া তুগরলের খোঁজ লইতে লাগিলেন। অবশেষে একদিন তাঁহার দলের মুহম্মদ শের-আন্দাজ এবং মালিক মুকদ্দর একদল বণিকের কাছে সংবাদ পাইলেন যে তুগরল দেড় ক্রোশ দূরেই শিবির স্থাপন করিয়া আছেন, পরদিন তিনি জাজনগর রাজ্যে প্রবেশ করিবেন। শের-আন্দাজ মালিক বেক্তরূসের কাছে এই খবর পাঠাইয়া নিজের মুষ্টিমেয় কয়েকজন অনুচর লইয়াই তুগরলের শিবির আক্রমণ করিলেন। তুগরল বলবনের সমগ্র বাহিনী আক্রমণ করিয়াছে ভাবিয়া শিবিরের সামনের নদী সাঁতরাইয়া পলাইবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু একজন সৈন্য তাঁহাকে শরাহত করিয়া তাঁহার মাথা কাটিয়া ফেলিল। তখন তুগরলের সৈন্যেরা শের-আন্দাজ ও তাঁহার অনুচরদের আক্রমণ করিল। ইঁহারা হয়তো নিহত হইতেন, কিন্তু মালিক বেতস্ তাঁহার বাহিনী লইয়া সময়মত উপস্থিত হওয়াতে ইঁহারা রক্ষা পাইলেন।
তুগরল নিহত হইলে বলবন বিজয়গৌরবে লুণ্ঠনলব্ধ প্রচুর ধনসম্পত্তি এবং বহু বন্দী লইয়া লখনৌতিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন। লখনৌতির বাজারে এক ক্রোশেরও অধিক দৈর্ঘ্য পরিমিত স্থান জুড়িয়া সারি সারি বধ্যমঞ্চ নির্মাণ করা হইল এবং সেই-সব বধ্যমঞ্চে তুগরলের পুত্র, জামাতা, মন্ত্রী, কর্মচারী, ক্রীতদাস, সৈন্যাধ্যক্ষ, দেহরক্ষী, তরবারি-বাহক এবং পাইকদের ফাঁসি দেওয়া হইল। তুগরলের অনুচরদের মধ্যে যাহারা দিল্লির লোক, তাহাদের দিল্লিতে লইয়া গিয়া তাহাদের আত্মীয় ও বন্ধুদের সামনে বধ করা হইবে বলিয়া বলবন স্থির করিলেন। অবশ্য দিল্লিতে লইয়া যাওয়ার পর বলবন দিল্লির কাজীর অনুরোধে তাহাদের অধিকাংশকেই মুক্তি দিয়াছিলেন। লখনৌতিতে এত লোকের প্রাণ বধ করিয়া বলবন যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার সমর্থকদেরও মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করিয়াছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের পরে বলবন আরো কিছুদিন লখনৌতিতে রহিলেন এবং এখানকার বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করিলেন। তাঁহার পর তিনি তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র বুগরা খানকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। বুগরা খানকে অনেক সদুপদেশ দিয়া এবং পূর্ববঙ্গ বিজয়ের চেষ্টা করিতে বলিয়া বলবন আনুমানিক ১২৮২ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
২
নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (বুগরা খান)
বলবনের কনিষ্ঠ পুত্রের প্রকৃত নাম নাসিরুদ্দীন মাহমুদ, কিন্তু ইনি বুগরা খান নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তুগরলের বিরুদ্ধে বলবনের অভিযানের সময় ইনি বলবনের বাহিনীর পিছনে যে বাহিনী ছিল, তাহা পরিচালনা করিয়াছিলেন। বলবন তুগরলের স্বর্ণ ও হস্তীগুলি দিল্লিতে লইয়া গিয়াছিলেন, অন্যান্য সম্পত্তি বুগরা খানকে দিয়াছিলেন। বুগরা খানকে তিনি ছত্র প্রভৃতি রাজচিহ্ন ব্যবহারেরও অনুমতি দিয়াছিলেন।
বুগরা খান অত্যন্ত অলস এবং বিলাসী ছিলেন। লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত হইয়া তিনি ভোগবিলাসের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিলেন। পিতা দূর বিদেশে, সুতরাং বুগরা খানকে নিবৃত্ত করিবার কেহ ছিল না।
এইভাবে বৎসর চারেক কাটিয়া গেল। তাঁহার পর বলবনের জ্যেষ্ঠ পুত্র মঙ্গোলদিগের সহিত যুদ্ধে নিহত হইলেন (১০ ফেব্রুয়ারি, ১২৮৫ খ্রী)। উপযুক্ত পুত্রের মৃত্যুতে বলবন শোকে ভাঙিয়া পড়িলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পীড়িত হইয়া শয্যা গ্রহণ করিলেন। বলবন তখন নিজের অন্তিম সময় আসন্ন। বুঝিয়া বুগরা খানকে বাংলা হইতে আনাইয়া তাঁহাকে দিল্লিতে থাকিতে ও তাঁহার মৃত্যুর পরে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করার জন্য প্রস্তুত হইতে বলিলেন। অতঃপর বুগরা খান তিন মাস দিল্লিতেই রহিলেন। কিন্তু কঠোর সংযমী বলবনের কাছে থাকিয়া ভোগবিলাসের তৃষ্ণা মিটানোর কোনো সুযোগই মিলিতেছিল না বলিয়া বুগরা খান অধৈর্য হইয়া উঠিলেন। এদিকে বলবনেরও দিন দিন অবস্থার উন্নতি হইতেছিল। তাঁহার ফলে একদিন বুগরা খান সমস্ত ধৈর্য হারাইয়া বসিলেন এবং কাহাকেও কিছু না বলিয়া আবার লখনৌতিতে ফিরিয়া গেলেন। পথে তিনি পিতার অবস্থার পুনরায় অবনতি হওয়ার সংবাদ পাইয়াছিলেন, কিন্তু আবার দিল্লিতে ফিরিতে তাঁহার সাহস হয় নাই। লখনৌতিতে প্রত্যাবর্তন করিয়া বুগরা খান পূর্ববৎ এদেশ শাসন করিতে লাগিলেন।