বাংলা দেশে তুগরল বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রকৃতি ছিল উদার। দানেও তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত। দরবেশদের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যয়নির্বাহের জন্য তিনি একবার পাঁচ মণ স্বর্ণ দান করিয়াছিলেন, দিল্লিতেও তিনি দানস্বরূপ অনেক অর্থ ও সামগ্রী পাঠাইয়াছিলেন। বলবনের কঠোর স্বভাবের জন্য তাঁহাকে সকলেই ভয় করিত, প্রায় কেহই ভালোবাসিত না। সুতরাং বলবনের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া তুগরল সমুদয় অমাত্য, সৈন্য ও প্রজার সমর্থন পাইলেন।
তুগরলের বিদ্রোহের খবর পাইয়া বলবন তাঁহাকে দমন করিবার জন্য আনুমানিক ১২৭৮ খ্রীষ্টাব্দে আউধের শাসনকর্ত্তা মালিক তুরমতীর অধীনে একদল সৈন্য পাঠাইলেন, এই সৈন্যদলের সহিত তমর খান শামলী ও মালিক তাজুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আর-একদল সৈন্য যোগ দিল। তুগরলের সৈন্যবাহিনীর লোকবল এই মিলিত বাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি ছিল, তাহাতে অনেক হাতি এবং পাইক (হিন্দু পদাতিক সৈন্য) থাকায় বলবনের বাহিনীর নায়কেরা তাহাকে সহজে আক্রমণ করিতেও পারিলেন না। দুই বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হইয়া কিছুদিন রহিল, ইতিমধ্যে তুগরল শত্রুবাহিনীর অনেক সেনাধ্যক্ষকে অর্থ দ্বারা হস্তগত করিয়া ফেলিলেন। অবশেষে যুদ্ধ হইল এবং তাহাতে মালিক তুরমতী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হইলেন। তাঁহার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হইয়া পলাইতে লাগিল, কিন্তু তাহাদের যথাসর্বস্ব হিন্দুরা লুঠ করিয়া লইল এবং অনেক সৈন্য–ফিরিয়া গেলে বলবন পাছে শাস্তি দেন, এই ভয়ে তুগরলের দলে যোগ দিল। বলবন তুরমতাঁকে ক্ষমা করিতে পারেন নাই, গুপ্তচর দ্বারা তাঁহাকে হত্যা করাইয়াছিলেন।
ইহার পরের বৎসর বলবন তুগরলের বিরুদ্ধে আর-একজন সেনাপতির অধীনে আর-একটি বাহিনী প্রেরণ করিলেন। কিন্তু তুরগল এই বাহিনীর অনেক সৈন্যকে অর্থ দ্বারা হস্তগত করিলেন এবং তাঁহার পর তিনি যুদ্ধ করিয়া সেনাপতিকে পরাজিত করিলেন।
তখন বলবন নিজেই তুগরলের বিরুদ্ধে অভিযান করিবেন বলিয়া স্থির করিলেন। প্রথমে তিনি শিকারে যাওয়ার ছল করিয়া দিল্লি হইতে সমান ও সনামে গেলেন এবং সেখানে তাঁহার অনুপস্থিতিতে রাজ্যশাসন ও মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো সম্পর্কে সমস্ত ব্যবস্থা করিয়া কনিষ্ঠ পুত্র বুগরা খানকে সঙ্গে লইয়া আউধের দিকে রওনা হইলেন। পথিমধ্যে তিনি যত সৈন্য পাইলেন, সংগ্রহ করিলেন এবং আউধে পৌঁছিয়া আরো দুই লক্ষ সৈন্য সগ্রহ করিলেন। তিনি এক বিশাল নৌবহরও সংগঠন করিলেন এবং এখানকার লোকদের নিকট হইতে অনেক কর আদায় করিয়া নিজের অর্থভাণ্ডার পরিপূর্ণ করিলেন।
তুগরল তাঁহার নৌবহর লইয়া সরযূ নদীর মোহানা পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি বলবনের বাহিনীর সহিত যুদ্ধ না করিয়া পিছু হটিয়া আসিলেন। বলবনের বাহিনী নির্বিঘ্নে সরযূ নদী পার হইল, ইতিমধ্যে বর্ষা নামিয়াছিল, কিন্তু বলবনের বাহিনী বর্ষার অসুবিধা ও ক্ষতি উপেক্ষা করিয়া অগ্রসর হইল। তুগরল লখনৌতিতে গিয়া উপস্থিত হইলেন, কিন্তু এখানেও তিনি সুলতানের বিরাট বাহিনীকে প্রতিরোধ করিতে পারিবেন না বুঝিয়া লখনৌতি ছড়িয়া চলিয়া গেলেন। লখনৌতির সম্ভ্রান্ত লোকেরা বলবন কর্ত্তৃক নির্যাতিত হইবার ভয়ে তাঁহার সহিত গেল।
বলবন লখনৌতিতে উপস্থিত হইয়া জিয়াউদ্দীন বারনির মাতামহ সিপাহশালার হসামুদ্দীনকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন এবং নিজে সেখানে একদিন মাত্র থাকিয়া সৈন্যবাহিনী লইয়া তুগরলের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন।
বারনি লিখিয়াছেন, তুগরল জাজনগরের (উড়িষ্যা) দিকে পলাইয়াছিলেন; কিন্তু বলবন তুগরলের জলপথে পলায়নের পথ বন্ধ করিবার জন্য সোনারগাঁওয়ে গিয়া সেখানকার হিন্দু রাজা রায় দনুজের সহিত চুক্তি করিয়াছিলেন। লখনৌতি বা গৌড় হইতে উড়িষ্যা যাইবার পথে সোনারগাঁও পড়ে না। এইজন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক বারনির উক্তি ভুল বলিয়া মনে করিয়াছেন, কেহ কেহ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে দ্বিতীয় জাজনগর রাজ্যের অস্তিত্ব কল্পনা করিয়াছেন, আবার কেহ কেহ বারনির গ্রন্থে ‘হাজীনগর’-এর স্থানে ‘জাজনগর’ লিখিত হইয়াছে বলিয়া মনে করিয়াছেন। কিন্তু সম্ভবত বারনির উক্তিতে কোনোই গোলযোগ নাই। তখন ‘জাজনগর’ বলিতে উড়িষ্যার রাজার অধিকারভুক্ত সমস্ত অঞ্চল বুঝাইত, সে সময় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলা এবং হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার অনেকাংশ উড়িষ্যার রাজার অধিকারে ছিল। সেইরূপ ‘সোনারগাঁও’ বলিতেও সোনারগাঁওয়ের রাজার অধিকারভুক্ত সমস্ত অঞ্চল বুঝাইত; তখনকার দিনে শুধু পূর্ববঙ্গ নহে, মধ্যবঙ্গেরও অনেকখানি অঞ্চল এই রাজার অধীনে ছিল। বলবন খবর পাইয়াছিলেন যে তুগরল জাজনগর রাজ্যের দিকে গিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরার্ধ পার হইলেই তিনি ঐ রাজ্যে পৌঁছিবেন, কিন্তু বলবনের বাহিনী তাঁহার নাগাল ধরিয়া ফেলিলে তিনি পূর্বদিকে সরিয়া গিয়া সোনারগাঁওয়ের রাজার অধিকারের মধ্যে প্রবেশ করিয়া জলপথে পলাইতে পারেন, তখন আর তাঁহাকে ধরিবার কোনো উপায় থাকিবে না। এইজন্য বলবনকে সোনারগাঁওয়ের রাজা রায় দনুজের সহিত চুক্তি করিতে হইয়াছিল।
এখন প্রশ্ন এই যে, এই রায় দনুজ কে? ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গে দশরথদেব নামে একজন রাজা ছিলেন, ইহার পিতার নাম ছিল দামোদরদেব। দশরথদেব ও দামোদরদেবের কয়েকটি তাম্রশাসন পাওয়া গিয়াছে। দামোদরদেব ১২৩০-৩১ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং অন্তত ১২৪৩-৪৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁহার পরে রাজা হন দশরথদেব, দশরথদেবের তাম্রশাসন হইতে জানা যায় তাঁহার ‘অরিরাজ–দনুজমাধব’ বিরুদ ছিল। বাংলার কুলজীগ্রন্থগুলিতে লেখা আছে যে লক্ষ্মণসেনের সামান্য পরে দনুজমাধব নামে একজন রাজার আবির্ভাব হইয়াছিল। বলবন ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে রায় দনুজের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। সুতরাং ‘অরিরাজ-দনুজমাধব’ দশরথদেব কুলজীগ্রন্থের দনুজমাধব এবং বারনির গ্রন্থে উল্লিখিত রায় দনুজকে অভিন্ন ব্যক্তি বলিয়া গ্রহণ করা যায়।