১১
জলালুদ্দীন মসূদ জানী, ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী ও তাজুদ্দীন অর্সলান খান
য়ুজবকের মৃত্যুর পরে লখনৌতি রাজ্য আবার দিল্লির সম্রাটের অধীনে আসে, কারণ ৬৫৫ হিজরায় (১২৫৭-৫৮ খ্রী) লখনৌতি টাকশাল হইতে দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রা উৎকীর্ণ হইয়াছিল। কিন্তু ঐ সময়ে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা কে ছিলেন, তাহা জানা যায় না। ৬৫৬ হিজরায় জলালুদ্দীন মসূদ জানী দ্বিতীয়বার লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন। কিন্তু ৬৫৭ হিজরার মধ্যেই তিনি পদচ্যুত বা পরলোকগত হন, কারণ ৭৫৭ হিজরায় যখন কড়ার শাসনকর্ত্তা তাজুদ্দীন অর্সলান খান লখনৌতি আক্রমণ করেন, তখন ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী নামে এক ব্যক্তি লখনৌতি শাসন করিতেছিলেন। ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী লখনৌতি অরক্ষিত অবস্থায় রাখিয়া পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করিতে গিয়াছিলেন। সেই সুযোগে তাজুদ্দীন অর্সলান খান মালব ও কালিঞ্জর আক্রমণ করিবার ছলে লখনৌতি আক্রমণ করেন। লখনৌতি নগরের অধিবাসীরা তিনদিন তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়া অবশেষে আত্মসমর্পণ করিল। অর্সলান খান নগর অধিকার করিয়া লুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। তাঁহার আক্রমণের খবর পাইয়া ইজুদ্দীন বলবন ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু তিনি অর্সলান খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া পরাজিত ও নিহত হইলেন। ইজুদ্দীন বলবনের শাসনকালের আর কোনো ঘটনার কথা জানা যায় না, তবে ৬৫৭ হিজরায় লখনৌতি হইতে দিল্লিতে দুইটি হস্তী ও কিঞ্চিৎ অর্থ প্রেরিত হইয়াছিল-এইটুকু জানা গিয়াছে। ইজুদ্দীন বলবনকে নিহত করিয়া তাজুদ্দীন অর্সলান খান লখনৌতি রাজ্যের অধিপতি হইলেন।
১২
তাতার খান ও শের খান
ইহার পরবর্তী কয় বৎসরের ইতিহাস একান্ত অস্পষ্ট। তাজুদ্দীন অর্সলান খানের পরে তাতার খান ও শের খান নামে বাংলার দুইজন শাসনকর্ত্তার নাম পাওয়া যায়, কিন্তু তাহাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
০২. বাংলায় মুসলমান রাজ্যের বিস্তার
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বাংলায় মুসলমান রাজ্যের বিস্তার
১
আমিন খান ও তুগরল খান
১২৭১ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে দিল্লির সুলতান বলবন আমিন খান ও তুগরল খানকে যথাক্রমে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা ও সহকারী শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করেন। তুগরল বলবনের বিশেষ প্রীতিভাজন ছিলেন। লখনৌতির সহকারী শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত হইয়া তুগরল জীবনের সর্বপ্রথম একটি গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার প্রাপ্ত হইলেন। আমিন খান নামেই বাংলার শাসনকর্ত্তা রহিলেন। তুগরলই সর্বেসর্বা। হইয়া উঠিলেন।
জিয়াউদ্দীন বারনির ‘তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী’ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে তুগরল “অনেক অসমসাহসিক কঠিন কর্ম” করিয়াছিলেন। তারিখ-ই-মুরারক শাহী’তে লেখা আছে যে, তুগরল সোনারগাঁওয়ের নিকটে একটি বিরাট দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাহা ‘কিলা-ই-তুগরল’ নামে পরিচিত ছিল। এই দুর্গ সম্ভবত ঢাকার ২৫ মাইল দক্ষিণে নরকিলা (লরিকল) নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। মোটের উপর, তুগরল যে পূর্ববঙ্গে অনেক দূর পর্যন্ত মুসলিম রাজত্ব বিস্তার করিয়াছিলেন, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। বারনির গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, তুগরল জাজনগর (উড়িষ্যা) রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে রাঢ়ের নিম্নার্ধ অর্থাৎ বর্তমানে মেদিনীপুর জেলার সমগ্র অংশ এবং বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও হুগলি জেলার অনেকাংশ জাজনগর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তুগরল জাজনগর আক্রমণ করিয়া লুণ্ঠন চালাইলেন এবং প্রচুর ধনরত্ন ও হস্তী লাভ করিয়া ফিরিয়া আসিলেন।
জিয়াউদ্দীন বারনির গ্রন্থ হইতে ইহার পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে যাহা জানা যায়, তাঁহার সারমর্ম নীচে প্রদত্ত হইল।
জাজনগর-অভিযান হইতে প্রত্যাবর্তনের পর তুগরল নানা প্রকারে দিল্লির কর্তৃত্ব অস্বীকার করিলেন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এই অভিযানের লুণ্ঠনলব্ধ সামগ্রীর এক-পঞ্চমাংশ দিল্লিতে প্রেরণ করিবার কথা, কিন্তু তুগরল তাহা করিলেন না। বলবন এতদিন পাঞ্জাবে মঙ্গোলদের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন বলিয়া বাংলার ব্যাপারে মন দিতে পারেন নাই। এই সময় তিনি আবার লাহোরে সাংঘাতিক অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। সুলতান দীর্ঘকাল প্রকাশ্যে বাহির হইতে না পারায় ক্রমশ গুজব রটিল তিনি মারা গিয়াছেন। এই গুজব বাংলা দেশেও পৌঁছিল। তখন তুগরল স্বাধীন হইবার সুবর্ণসুযোগ দেখিয়া আমিন খানের সহিত শত্রুতায় লিপ্ত হইলেন; অবশেষে লখনৌতি নগরের উপকণ্ঠে উভয়ের মধ্যে এক যুদ্ধ হইল। তাহাতে আমিন খান পরাজিত হইলেন।
এদিকে বলবন সুস্থ হইয়া উঠিলেন এবং দিল্লিতে আসিয়া পৌঁছিলেন। তাঁহার অসুস্থ থাকার সময়ে তুগরল যাহা করিয়াছিলেন, সেজন্য তিনি তুগরলকে শাস্তি দিতে চাহেন নাই। তিনি তুগরলকে এক ফরমান পাঠাইয়া বলিলেন, তাঁহার রোগমুক্তি যেন তুগরল যথাযোগ্যভাবে উদযাপন করেন। কিন্তু তুগরল তখন পুরোপুরিভাবে বিদ্রোহী হইয়া গিয়াছেন। তিনি সুলতানের ফরমান আসার অব্যবহিত পরেই এক বিপুল সৈন্যসমাবেশ করিয়া বিহার আক্রমণ করিলেন; বলবনের রাজত্বকালেই বিহার লখনৌতি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হইয়াছিল। ইহার পর তুগরল মুগীসুদ্দীন নাম গ্রহণ করিয়া সুলতান হইলেন এবং নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ ও খুবা পাঠ করাইলেন। তাঁহার দরবারের জাঁকজমক দিল্লির দরবারকেও হার মানাইল।